রিভিউ
মন্ত্রমুগ্ধ সঙ্গীতের এই বান্দিশ। ওয়েব সিরিজ রিভিউ : বান্ডিশ বান্ডিত্স
বিপাশা দাস : পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম জীব হলো গিয়ে মানব। শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকার গুণের ও অংশীদার তারা। সঙ্গীত যার মধ্যে একটি, লক্ষ্য করে দেখবেন নিত্যদিনের প্রত্যেকটি কর্মের মধ্যে আপনি সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন খুঁজে পাবেন। এই আশ্চর্য মেলবন্ধন কে কাজে লাগিয়ে পরিচালক অঙ্কিত তিওয়ারি বান্ডিশ বান্ডিত্স নামক একটি ওয়েব সিরিজ আমাজন প্রাইম এরপর্দায় নিয়ে এলেন।
গুরুর প্রতি শিষ্যের অপার ভক্তি, সঙ্গীতের প্রতি অনবদ্য প্রেম একজন নিষ্ঠাবান শিষ্যের পরিচয়। পুরাকালের কাহিনী তো সবার কাছে জ্ঞাত, গুরুদেব দ্রোণাচার্য একলব্য এর আঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিবেসে চেয়ে গুরুভক্তির নিদর্শন স্বরূপ অক্ষত রাখেন। তেমনি এই ছবিতে রাধে তার টাকুরদা পণ্ডিত রাধেমোহনকে নিজের গুরুভক্তি এবং প্রেমের নিদর্শন কঠোর পরিশ্রমের সাথে দিয়েছে।
এবার যদি সঙ্গীতের ব্যাখ্যা চান তাহলে বলবো যথাযথ তার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ইতিহাসের দিকে নজর দিলে বুঝতে পারবেন সঙ্গীতের মহিমা কতটা ব্যাপ্ত। আকবরের নবরত্ন অলংকৃত তানসেন নিজের সঙ্গীতেরদ্বারা বৃষ্টি নামাতে পারতেন, ক্ষিপ্ত হাতিকে শান্ত করার ক্ষমতা ও তার গানের দ্বারা ফুটে ওঠে। তবে এই ওয়েব সিরিজের শেষে এমনটাই পরিচয় পেয়ে থাকবেন। ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল গানের সঙ্গেপপ মিউজিক এর অসাধারণ যুগলবন্দি সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। সাথে রাজস্থানের সাংস্কৃতিক প্রতিপত্তি,রাজার উপস্থিতি সবকিছুই যেনো ইতিহাসকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট। আমাদের ভারতবর্ষে ফোক গানের কদর এক আলাদা স্তরেই বিদ্যমান, এত সুন্দর ভাবে তার পরিবেশন সাথে বিভিন্ন অসাধারণ কিছু রাগের উপস্থিতি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের প্রেমে পড়ার জন্য যথেষ্ট।
অতুল কুলকর্ণী, নাসিরউদ্দিন সাহ, তৃধা চৌধুরী, শিবা চড্ডা দের মত নামকরা কিছু তারকাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সবার তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয় এর পরিচয় আমরা আগেও পেয়েছি এই ওয়েব সিরিজেওবেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কিন্তু ঋত্বিক ভৌমিক (রাধে) এবং শ্রেয়া চৌধুরী (তামান্না) র অসাধারণ অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। লিড রোল রাধের পুরো ওয়েব সিরিজ টিকে এক আলাদা জায়গায় স্থান দিয়েছে সাথে তার বন্ধু কবীরের কিছু হাস্যকর মুহূর্তও এবং অটুট বন্ধুত্বের সাক্ষী এই সিরিজটি।
ডিরেকশনে র কথা বললে রাজেস্থানের যোধপুর নামক এই শহরটির সৌন্দর্য্য কে নব বধূর সাজের সাথে মিলিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে যা এককথায় অতুলনীয়। কিন্তু কোথাও গিয়ে কিছু খামতি চোখে ধরা পড়েই। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রকাশ থাকলেও অত্যধিক পরিমাণে অকথ্য ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যার ফলে পরিবারের সঙ্গে বসে দেখার কোনো সুযোগই নেই। সিরিজটির শেষের দিকে পপ এবং ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের ছোয়া তো দূর নায়িকার উপস্থিতিই সরিয়ে দেওয়া হয়। লেখার ক্ষেত্রে এসব খামতি এড়িয়ে যাওয়া দায়।
শ্রীরাম গণপথী র চলচ্চিত্রশিল্প সত্যিই খুবই সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এডিটিং এ লিড রোল রাধে র মাস্কড ম্যান এর থিওরী এবং তার উপস্থাপনা কে দুর্বল ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে মনমাতানো গানের যুগলবন্দী টি সত্যিই অবিস্মরণীয়। সেটা যদি নাই দেখলেন তাহলে কি দেখলেন প্রশ্ন করতে হয়। সঙ্গীত জগতের তিন অনবদ্য সৃষ্টিকর্তা কর্তা সংকর মহাদেভান, এহসান এবং লয়ের হাত ধরেই এই সিরিজের যে উত্থান। তাদের গাওয়া প্রত্যেকটি রাগের মধ্যে যে আলাদাই আবেগ, অনুভূতি,বেদনা,বিরহ,প্রেমের স্পর্ধা প্রকাশ পেয়েছে যা সত্যিই না শুনে বোঝা সাধ্যের বাইরে।
রিভিউ
সময় ভ্রমণকারী যানে নতুনত্বের সন্ধান। ওয়েব সিরিজ রিভিউ : JL50
বিপাশা দাস : ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানীদের টাইম ট্রাভেল এর আশ্চর্য সমস্ত লজিক শুনে মাথা প্রায় ঘুরে যেত। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে ব্যাপার গুলি বুঝতে সময় লাগলেও সেই নিয়ে একলা বসে ভাবতে বেশ ভালই লাগে। বাস্তবে এই বস্তুটির অবস্থান সত্যিই বর্তমান থাকলে কত কিছুই না করা যেত, অতীতে গিয়ে কিছু ঠিক করা, ভবিষ্যত দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই অসাধারণ কনসেপ্টটাকে কাজে লাগিয়ে শৈলেন্দ্র ভিয়াস তাকলাগিয়ে দেওয়া একটি ওয়েব সিরিজ দর্শকের কাছে নিয়ে এলেন নাম JL50। মুক্তি পেয়েছে সনি লিভ এ। ওয়েব সিরিজ এর কাহিনীর শুরুতে একটি প্লেনকে দেখানো হয় যার নাম AO 26। প্লেনটি হঠাৎ ই কিছু জঙ্গি দ্বারা আটক করা হয় সাথে একটি দাগী আসামীকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়। তারপরমুহুর্তে আরো একটি প্লেন পশ্চিমবঙ্গের ‘লাভা’ নামক স্থানে ভেঙে পড়ে।
এই ভয়নক দুর্ঘটনাটি সনাক্ত করার দায়ভার সিবিআই এর ওপর এসে পড়ে এবং সেখান থেকেই গল্পের ভয়ানোক মোড় দেখা দেয়। এইভেঙে পড়া প্লেনটি নাকি ৩৫ বছরের পুরোনো তাহলে এতগুলো বছর ধরে তার কি কোনও অস্তিত্বই ছিল না, না আসলে এটি টাইম ট্রাভেল এর সাক্ষী এটাই গল্পের মূল বিষয়।
আমরা আগেও এরকম টাইম ট্রাভেল সংক্রান্ত সিনেমার সাক্ষী থেকেছি। মূলত হলিউডে ‘ব্যাক টু দি ফিউচার’ ছবি বা ‘ডার্ক’ নামক ওয়েব সিরিজ এ এই ঘরানা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু ভারতীয়চলচ্চিত্র জগতে এই প্রথম বার টাইম ট্রাভেল টিকে এতটা নিখুঁত ভাবে রহস্য – রোমাঞ্চে ভরা প্লটের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। ১০০ বছরেরও বেশী সময় আগে“অ্যালবার্ট আইনস্টাইন” এর এই থিওরীর মর্ম যে কতটা এখন মানুষ হয়ত টের পাচ্ছে। কিন্তু এর বাস্তবতা কতটা সেই নিয়ে আজও অনেক তর্ক বিতর্ক, কারণ এই যন্ত্রের আবিষ্কার কোনো অসৎ ব্যক্তির হাতে যাওয়া মানেই যে ধ্বংসের ইঙ্গিত তার টের পাওয়া খুব বেশি কষ্টকর নয়। এই ধারণার ও ইঙ্গিত এই ওয়েব সিরিজে পেয়ে যাবেন।
এবার অভিনয়ে আসা যাক, লিড রোলগুলিতে অভয় দেওল, পীযূষ মিশ্রা, ঋত্বিকা আনন্দ এবং পঙ্কজ কাপুর কে দেখা গেছে। এদের আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো সাহস হয়তো আমার নেই, সিবিআই অফিসার অভয় দেওলের তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয় সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নজর কেড়ে রেখেছে।
এরপর পীযূষ মিশ্রা র অভিনয় কিছু সময়ের জন্য হলেও তাকে নিয়েই পুরো প্লটটি। তারই বের করা টাইম ট্রাভেল এর লুপ কোথায়, কিভাবে যেতে হবে সবকিছুই খুব দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। পঙ্কজ কাপুরের কথা বলতে গেলে, বয়েষ্ক একটু পাগল গোছের প্রফেসর খারাপ ভালো সব রকম চরিত্রই নিজের মধ্যে ধরেরেখে বেশ ভালোভাবে নিজেকে তুলে ধরেছেন।
ঋত্বিকা আনন্দ যিনি কিনা ৩৫ বছর আগেকার বিহু ঘোষ সেইসময় তিনি আর পীযূষ মিশ্রা (বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জী) প্লেন দুর্ঘটনার বেঁচে যান। এতবছর পর একটা আলাদা জগতে যেন নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন বলে তার দাবী তার অনবদ্য অভিনয় বেশ নজর কেড়েছে। সাথে রাজেশ শর্মার কিছু হাস্যকর মুহূর্তও বেশ সুন্দর।
কমপ্যাক্ট একটি ওয়েব সিরিজ যার মধ্যে ভয়, রহস্য, দুঃখ, আনন্দ,অ্যাকশন সব ভরপুর আছে। ডিরেকশন এবং স্টোরি প্লে উভয় ক্ষেত্রেই দুর্দান্ত কাজ হয়েছে। সাধারণ মানুষের মন কাড়ার জন্য যথেষ্ট।সাথে ইতিহাসের সম্রাট অশোকের অসাধারণ শক্তি সমৃদ্ধ ৯ টি বই যে তুলে ধরা হয়েছে সেটিও বেশ মনে লেগেছে।
কিছু কিছু দিক একটু হলেও অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। যেমন কিভাবে এই টাইম ট্রাভেল টি হচ্ছে একটু VFX দ্বারা সুন্দর ভাবে দেখলে ভালো লাগতো। প্লেন দুর্ঘটনার দৃশ্যটি সেই ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়নি।কিন্তু সব শেষে ওয়েব সিরিজটির প্রসংশা অনিবার্য কারণ এতদিন পর বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের মেবন্ধনে গড়ে ওঠা চিত্রটি পেয়ে বেশ আনন্দিত এবং আশাবাদী।