ধনবিজ্ঞান
কৃষি ব্যবস্থায় শাসন ও শোষণের পর্যায়ক্রম
ফাল্গুনী পান : সারা দেশ জুড়ে বিশেষত পাঞ্জাব হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ সংগঠিত কৃষক আজ দিল্লির রাজপথের দখল নিয়েছে। তেভাগা তেলেঙ্গানা নকশালবাড়ির পর এটাই বোধহয় ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ এবং আলোচ্য কৃষক আন্দোলন যা সরাসরি পার্লামেন্টরি ডেমোক্রেসিকে একটি সম্মুখ চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বর্তমান সরকার প্রণোদিত যে তিনটি কৃষিবিলের বিরোধিতা সারা দেশের কৃষককে আজ সংগঠিত রূপ দিয়েছে সে নিয়ে বলার আগে ভারতবর্ষের কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।
ভারত রাষ্ট্রের মোট প্রশাসনিক পরিধি ৩২ লক্ষ ৮৭ হাজার বর্গ কিমি। যার মধ্যে ১৫ লক্ষ ৯৭ হাজার বর্গ কিমি এলাকা কৃষি জমি। অর্থাৎ মোট প্রশাসনিক ভূখণ্ডের অর্ধেক এলাকা জুড়ে কিছু না কিছু চাষ করা হচ্ছে। যার মধ্যে দানা শষ্য থেকে শুরু করে তৈল বীজ কিংবা আখ পাট যেমন আছে তেমনি আছে আপেল কিংবা চা কিংবা মশলা। এই ব্যপক কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে দেশের মোট ৪৮ কোটি ১০ লক্ষ কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে ২৬ কোটি ৩০ লক্ষ জন যুক্ত।
স্বাধীনতার প্রায় ১৮০ বছর আগে ভারতের সমাজের স্বাভাবিক বিকাশকে রোধ করে নব্য জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন করেছিল ব্রিটিশরা, যার বোঝা আজ অবধি ভারতের বিভিন্ন শ্রেণীর কৃষক বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা যদি ১১৭৬ এর মন্বন্তরের কারণ খুঁজতে যাই তাহলেই দেখতে পাবো ব্রিটিশ বিজিত এলাকাতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বেও কৃষি নিয়ে তারা বিভিন্ন পরীক্ষা নিরিক্ষা শুরু করে, যার সাথে কৃষকের সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না, সেখানে কৃষি এবং কৃষক ছিল শুধুমাত্র কর আদায়ের পদ্ধতি। কৃষকের কাছে কম দামে ফসল কিনে তা চড়া দামে বিক্রি হত বাজারে। কৃষিকে ভিত্তি করে ভারতের বিশেষ করে বাংলা ও বিহারে যে দেশীয় পুঁজির বিকাশ ঘটছিল, ব্রিটিশ পুঁজি ও ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থাতে তা এক লহমায় শেষ হয়ে যায়।
অন্যদিকে মানিকচাঁদ-ফতেচাঁদের হাত ধরে যে ব্যাঙ্ক পুঁজির বিকাশ ঘটছিল যা আদতে শিল্পপুঁজির সহায়ক হয়ে উঠছিল তাও ক্রমশ ব্রিটিশ পুঁজির দালালিতে মত্ত হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটিশ পুঁজি ও তার দালালরা এলাকা ও দেশীয় পুঁজির একচেটিয়া দখল নিল।
তথাকতিত স্বাধীনতার পর ব্রিটিশের জায়গা নিল সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলি, খুব নির্দিষ্ট ভাবে বললে আমেরিকা। ভারতে ক্রমশ এক নয়া উপনিবেশ ধরনের আধা উপনিবেশবাদের সূচনা হল। ভারতের সমস্ত আইন ও নিয়মের লক্ষ হয়ে উঠল সাম্রাজ্যবাদি দেশগুলির সেবা এবং দেশের অভ্যন্তরে সামন্ততন্ত্রের রক্ষা। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে কৃষক জনসাধারনের জমি আন্দোলনের চাপে প্রথমে উত্তরপ্রদেশ ও পরবর্তীতে অন্যান্য রাজ্যে জমিদারি বিলোপ আইন প্রচলন হতে শুরু করে। ৫০ দশক জুড়ে জমিদারি বিলোপ আইন ও নতুন সিলিং আইনের ফলে খুব সামান্য পরিমাণ জমি ভূমিহীনদের হাতে যায় এবং তার পরিমাণ অতিব নগণ্য।
স্বাধীনতার ৭০ বছর পর ২০১৮ সালে প্রকাশিত কেন্দ্র সরকারের কৃষি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট কৃষি জমির ২৯% জমা হয়ে আছে ৪.৩৩% মাঝারি ও ধনী কৃষকের হাতে অন্যদিকে ৮৭% প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের হাতে আছে ৪৭.৩৫% জমি, এই রিপোর্টই তার প্রমাণ। যদি মাঝারি,ধনী,অতিধনী কৃষকদের ,অলিয়ে হিসেব করা যায় তাহলে দেখা যাবে ১৩.৭৮% হাতে আছে ৫২.৬৫% শতাংশ কৃষি জমি। [ ক্ষুদ্র কৃষক — > ২ হেক্টর, মাঝারি কৃষক – ২ হেক্টর থেকে ১০ হেক্টর, ধনী কৃষক < ১০ হেক্টর]
ভারতবর্ষের এলাকা বিশেষে জমির উর্বরতার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই পার্থক্যকে লক্ষ্য রেখে কংগ্রেস সরকার জমি ভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে শুরু করে। এলাকা চিহ্নিত হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা থেকে শুরে হয় ব্লক ব্যবস্থা। ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও আমেরিকার সরকার ভারতকে এই মর্মে ১০ লক্ষ কোটী ডলার ধার দেয়। সেচ প্রকল্পগুলি গড়ে ওঠে আমেরিকার টেনিসি ভ্যালি কর্পোরেশনের আদলে যেমন দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন। ১৯৫৫ সালে আমেরিকা-ভারত চুক্তি মারফৎ দেশ জুড়ে মার্কিন ধাঁচে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সূচনা হয়।
“ভারতের খাদ্য সমস্যা ও তার সমাধানের উপায়” শীর্ষক রিপোর্টে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ‘নিবিড় পদ্ধতির’ কথা বলে। নিবিড় পদ্ধতি অর্থাৎ সারা দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে দেশের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা বেছে নিয়ে সেখানে পুঁজির বিনিয়োগ সর্বাধিক করা। প্রত্যক্ষ শাসন শুরুর ২০ বছরের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ভারতের কৃষির কিছু পরিমাঙত পরিবর্তন করে ফেলেছিল এখন প্রয়োজন ছিল সাম্রাজ্যবাদী সার,কীটনাশক, বীজ ভারতের বাজারে প্রবেশ করানোর। নিবিড় পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে সেটাও তারা করে ফেলল, আর তৎকালীন সরকার সাম্রাজ্যবাদের দালালি ছাড়া দেশের কৃষককে আর কিছুই দিতে পারেনি।
৬০’র দশকের শেষে গঙ্গা অববাহিকা (পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও বাংলার কিছু অংশ) জুড়ে সবুজ বিপ্লবের প্রকল্প আরও নিবিড়তর পদ্ধতির রূপায়ন ছাড়া আর কিছুই নয়। পরবর্তীতে এই অঞ্চলগুলো কৃষিনীতির নিরিখে সরকারের চোখের মণিতে পরিণত হল। ভারতের কৃষির মূল প্রবণতা ভোগ অর্থাৎ কৃষিজ দ্রব্য বা ফসলের পণ্যে পরিণত হওয়ার প্রবণতা খুব কম। প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও আধা মাঝারি কৃষকের ফসলের একটা বড় অংশ চলে যায় ধার দেনা মেটাতে। কৃষিতে পুনর্বিনিয়োগ তো দূরের কথা কৃষক চিরকাল পড়ে থাকে লোকশান ও ঋণের গর্তে। আমাদের দেশের কৃষকদের মোট কৃষি ঋণের মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬৬%, অর্থাৎ এই ঋণ প্রদান করে এলাকা মহাজন ও সার বীজের কারবারিরা। আর এই ঋণ মেটাতে প্রতিবছরই ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষকরা নতুন করে ঋণচক্রে প্রবেশ করছে।
অন্যদিকে ২০১১ সালে দেশের সমস্ত ক্ষেত্রের মোট পুঁজি নির্মাণের মাত্র ৮.৫% ছিল কৃষি ও কৃষির সাথে যুক্ত অন্যান্য ক্ষেত্রের যা ২০১৭-১৮ নেমে হয়েছে ৬.৪%। অর্থাৎ দশ বছরে কৃষিতে পুনর্বিনিয়োগের হার কমেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে অতচ উৎপাদন ও জমির পরিমাণ বেড়েছে। সরকার কৃষিতে তার ব্যয় কমিয়েছে ধারাবাহিক ভাবে। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্বমুদ্রা সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী কৃষিক্ষেত্রকে তুলে দেওয়া হয়েছে বৃহৎ পুঁজির হাতে। খুচর ব্যবসায় ১০০% বিদেশী বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে অনেক আগেই দেশের খুচরো ব্যবসা ওয়ালমার্ট, অ্যামাজন, নেশলের মতো দানবের মুখে ঠেলে দিয়েছে সরকার।
( ক্রমশ…..)