রিভিউ
সাই-ফাইয়ে ভারতীয় পুরান মিশিয়ে সুস্বাদু ককটেল। মুভি রিভিউ : কার্গো (2020)
সৌমেন্দু বাগ : মানুষের সাথে রাক্ষসদের চিরাচরিত ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর জন্য শান্তিচুক্তি স্থাপিত হলো। এর ফলে যমরাজের কাজের বোঝাও কমলো। মানুষও নিশ্চিন্ত হলো তাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে। এভাবেই রাক্ষস আর মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা হলো। সেই ‘মৃত্যু পরবর্তী পরিবহন’ এর সংস্থা স্থাপিত হয়েছে যার মাধ্যমে পৃথিবীর মৃত মানুষেরা কোনোরকম কষ্ট- অসুবিধের মাধ্যমে না গিয়ে সুষ্ঠুভাবে পরবর্তী জীবনে প্রবেশ করতে পারে। আর এই পরিবহনের দায়িত্বে থাকা রাক্ষস মহাকাশচারীদের মধ্যে একজন হলেন আমাদের ছবির মূল চরিত্র প্রহস্থ (ভিক্রান্ত মাসি) । তাঁকে আর তাঁর জীবনকে ঘিরেই প্রায় দুঘন্টার আরতি কাদাভ এর ছবি এই কার্গো।
ভারতের দ্বিতীয় স্পেস নির্ভর ছবি এবং সম্ভবত প্রথম সাই -ফাই ঘরানার ছবি। যদিও সায়েন্স এখানে নিমিত্ত মাত্র। বিজ্ঞান কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জীবনের গল্প বুনেছেন পরিচালক নিজের হাতে। তাঁরপ্রথম কাজ এটি।খুব সাহসিকতার সাথে এমন একটা বিষয় বেছে নিয়েছেন তিনি এবং তার জন্য সহায়তা পেয়েছেন অনুরাগ কাশ্যপ, নবীন শেট্টি, বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানে দের।
ছবিতে আসি। গত কয়েক বছর ধরে পুস্পক 634A তে চড়ে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের পরিবহনের কাজ সুশৃঙ্খল ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রহস্থ। একজন দায়িত্ববান, বুদ্ধিমান মহাকাশচারী হিসেবে সারাদিন নিজের কাজ করে যান নিয়মমাফিক। কোনো ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু এই একঘেয়ে জীবনেই এক দমকা বাতাসের মতো আসে যুবিষ্কা ( শ্বেতা ত্রিপাঠি) তার সহকারী হয়ে। মুহূর্তের মধ্যে ক্লান্ত, বেরঙা পুস্পকে যেন রঙিনহয়ে উঠলো। নিষ্প্রাণ দেওয়াল গুলো প্রাণ ফিরে পেল। এতদিন ধরে কারোর সাথে সম্পর্ক না রাখা, আত্মমগ্ন, প্রহস্থ যে ধীরে ধীরে দেওয়াল তুলে দিয়েছিল নিজের চারিদিকে, সেই দেওয়ালের মধ্যে এক জানলার মতো আবির্ভুত হলো যুবিষ্কা। গোটা পৃথিবীকে এক লহমায় প্রহস্থের সামনে একটা ক্যানভাসে এঁকে দিলো। শুধু মৃত কার্গোদের অসহায় মুখ নয়, প্রহস্থ ও ডায়েরিতে আঁকার জন্য নতুন একটা মুখ পেলো।এতোদিন ধরে আঁকা স্কেচ গুলো এক রঙের হলেও এই স্কেচটা রঙিন করে ফেলে সে হয়ত অজান্তেই। এই ব্যাপারটা ক্যামেরা ম্যান আর প্রোডাকশন ডিজাইনার এর দক্ষতায় আরো ভালো লেগেছে। প্রথমদিকে প্রহস্থ এর নিষ্প্রভ জীবন দেখাতে গিয়ে ক্যামেরা বেশিরভাগ জায়গায় স্থির রাখা হয়েছে, ফ্রেম গুলোও খুব নিষ্প্রাণ টোনের। কিন্তু যুবিষ্কা হলুদ রঙের স্পেসশুট পরে এসে সবকিছুকে রঙ্গীন করে দিলো। নিজের মনে চিঠি লেখা প্রহস্থের কাছে সোস্যাল মিডিয়ার হৈচৈ পৌছলেও ছুঁতে পারেনি।
যুবিষ্কা শুধু মাত্র এই ছবির চরিত্র নয়।আমাদের প্রত্যেকের একাকিত্বে ঘেরা দুপুরে আসা এক দখিনা বাতাস যা সারদিনের ক্লান্তি ধুইয়ে দেয়, রাতের শীতলতা টুকু এনে দেয় আর একবার নিঃশব্দে মনখারাপকরিয়ে দেয়। পৃথিবী থেকে আসা একের পর বিভিন্ন রকমের মানুষের আত্মাকে কে প্রহস্থ যখন পরবর্তী জীবনের জন্য তৈরি করে, সে অবাক চোখে ভাবে এভাবেই পৃথিবীর এক একটা গল্প, এক একটা চিন্তা তাঁদেরমৃত্যর সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়। মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায় তাদের সারাজীবনের সঞ্চয়। কেও কেও পরের জীবনেও তাঁর অসম্পূর্ণ কাজ করবেন বলে ভাবেন। কেও ভাবেন তাঁর ফেলে আসা আপনজনদের কি হবে। এ সবকিছু দেখে শুনে প্রায় সারাজীবন একা থাকা প্রহস্থ ভাবে তাঁর দীর্ঘ জীবনের থেকে তো এই মানুষগুলোর ক্ষুদ্র জীবনে অনেক গল্প থাকে, স্মৃতি থাকে, না -পাওয়া থাকে। আর এই সবকিছু নিয়েই তো বেঁচে থাকে। মরে গিয়ে আবার ফিরে আসা। দীর্ঘ জীবন বড় ক্লান্তিকর। সেইসঙ্গে যুবিস্কাও অনুভব করে আসলে দিনের শেষে আমরা সবাই একা। একাকীত্বই লড়তে শেখায়, উপলব্ধি করতে শেখায়। এই ভাবে দুই বিপরীত মেরুর চরিত্র দুটো ভিন্ন মতের উপলব্ধি ঘটাতে সক্ষম হয়।
অসাধারন কাজের দৃষ্টান্ত একেবারেই বলা যাবে না। গল্পের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় ফাঁক রয়েছে, ছবির মাঝামাঝি জায়গায় বোঝা যাচ্ছিল না ছবির গল্প আসলে কোনটা। সাবপ্লট গুলো গুরুত্ব পেয়ে মূল গল্পের ভাবনা টা হারিয়ে যায়। কিন্ত যে জন্য এই ছবি প্রশংসনীয় তা হলো এই ছবির টেকনিক্যাল দিক। আমার গল্প যদি স্পষ্ট হয়, তাহলে বাজেট যে কোনো ব্যাপার না, ফের প্রমাণিত হলো। সাই -ফাই বা স্পেস সিনেমার আকাশছোঁয়া বাজেট এর ধারণা কে সপাটে থাপ্পড় দিয়েছে এই ছবি। অসাধারণ পরিচালনা এবং অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি। এতটুকু অযথা ক্যামেরার কাজ নেই। ছবির টোনের সাথেই ধীর- স্থির ভাবে ক্যামেরাঘুরেছে।
প্রশংসা করার আরেকটা জায়গা হচ্ছে সংগীতের ব্যবহার। ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক না ব্যবহার করে শান্ত, নিঃশব্দ মহাকাশের পরিবেশ তৈরি করা এক কথাই অনবদ্য। মাঝে মাঝে কিছু যান্ত্রিক শব্দ সেই নিঃস্তব্ধতা ভেঙে ফেলে জীবনের অস্তিত্ব প্রমান করে। একটি মাত্র গান ব্যবহার করা হয়েছে, যেটাতে আশির দশকের পপ সংগীতের একটা ছোঁয়া রয়েছে, আসলে প্রহস্থ-যুবিষ্কার এই জীবনদর্শনের দূরত্ব এর রূপকার্থেই ব্যবহার হয়েছে।
আর যার কথা না বললেই নয় তা হলো অভিনয়। শক্তিশালী দুজন অভিনেতা-অভিনেত্রী যাদের অভিনয়ে খুঁত বের করা শক্ত আমাদের মতো অনভিজ্ঞর কাছে। ভিক্রান্ত মাসি তাঁর স্বভাব মতোই শান্ত, দৃঢ়। অন্যদিকেশ্বেতার চেহারার মধ্যে এক মুগ্ধ করার মতো ছেলেমানুষি রয়েছে যা এই চরিত্রের সঙ্গে দারুন মিলেছে (35 বছর বয়স তাঁর মেনে নিতে কষ্ট হয়)।
শেষে এটুকুই বলার যে, গল্পের মধ্যে গভীরতা এবং প্রভাব কম থাকলেও কম বাজেটকে অবলম্বন করে যে এরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছেন কিছু মানুষ, এই কারণেই সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাবেন নির্মাতারা। অনেক বড়বড় বাজেট নিয়ে হাস্যকর ছবি দেখতে আমরা হল ভরাই, চলুন এই কার্গো কে আমরা তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিই যাতে এই পথটা আর অজানা না থাকে।
রিভিউ
মন্ত্রমুগ্ধ সঙ্গীতের এই বান্দিশ। ওয়েব সিরিজ রিভিউ : বান্ডিশ বান্ডিত্স
বিপাশা দাস : পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম জীব হলো গিয়ে মানব। শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকার গুণের ও অংশীদার তারা। সঙ্গীত যার মধ্যে একটি, লক্ষ্য করে দেখবেন নিত্যদিনের প্রত্যেকটি কর্মের মধ্যে আপনি সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন খুঁজে পাবেন। এই আশ্চর্য মেলবন্ধন কে কাজে লাগিয়ে পরিচালক অঙ্কিত তিওয়ারি বান্ডিশ বান্ডিত্স নামক একটি ওয়েব সিরিজ আমাজন প্রাইম এরপর্দায় নিয়ে এলেন।
গুরুর প্রতি শিষ্যের অপার ভক্তি, সঙ্গীতের প্রতি অনবদ্য প্রেম একজন নিষ্ঠাবান শিষ্যের পরিচয়। পুরাকালের কাহিনী তো সবার কাছে জ্ঞাত, গুরুদেব দ্রোণাচার্য একলব্য এর আঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিবেসে চেয়ে গুরুভক্তির নিদর্শন স্বরূপ অক্ষত রাখেন। তেমনি এই ছবিতে রাধে তার টাকুরদা পণ্ডিত রাধেমোহনকে নিজের গুরুভক্তি এবং প্রেমের নিদর্শন কঠোর পরিশ্রমের সাথে দিয়েছে।
এবার যদি সঙ্গীতের ব্যাখ্যা চান তাহলে বলবো যথাযথ তার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ইতিহাসের দিকে নজর দিলে বুঝতে পারবেন সঙ্গীতের মহিমা কতটা ব্যাপ্ত। আকবরের নবরত্ন অলংকৃত তানসেন নিজের সঙ্গীতেরদ্বারা বৃষ্টি নামাতে পারতেন, ক্ষিপ্ত হাতিকে শান্ত করার ক্ষমতা ও তার গানের দ্বারা ফুটে ওঠে। তবে এই ওয়েব সিরিজের শেষে এমনটাই পরিচয় পেয়ে থাকবেন। ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল গানের সঙ্গেপপ মিউজিক এর অসাধারণ যুগলবন্দি সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। সাথে রাজস্থানের সাংস্কৃতিক প্রতিপত্তি,রাজার উপস্থিতি সবকিছুই যেনো ইতিহাসকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট। আমাদের ভারতবর্ষে ফোক গানের কদর এক আলাদা স্তরেই বিদ্যমান, এত সুন্দর ভাবে তার পরিবেশন সাথে বিভিন্ন অসাধারণ কিছু রাগের উপস্থিতি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের প্রেমে পড়ার জন্য যথেষ্ট।
অতুল কুলকর্ণী, নাসিরউদ্দিন সাহ, তৃধা চৌধুরী, শিবা চড্ডা দের মত নামকরা কিছু তারকাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সবার তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয় এর পরিচয় আমরা আগেও পেয়েছি এই ওয়েব সিরিজেওবেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কিন্তু ঋত্বিক ভৌমিক (রাধে) এবং শ্রেয়া চৌধুরী (তামান্না) র অসাধারণ অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। লিড রোল রাধের পুরো ওয়েব সিরিজ টিকে এক আলাদা জায়গায় স্থান দিয়েছে সাথে তার বন্ধু কবীরের কিছু হাস্যকর মুহূর্তও এবং অটুট বন্ধুত্বের সাক্ষী এই সিরিজটি।
ডিরেকশনে র কথা বললে রাজেস্থানের যোধপুর নামক এই শহরটির সৌন্দর্য্য কে নব বধূর সাজের সাথে মিলিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে যা এককথায় অতুলনীয়। কিন্তু কোথাও গিয়ে কিছু খামতি চোখে ধরা পড়েই। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রকাশ থাকলেও অত্যধিক পরিমাণে অকথ্য ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যার ফলে পরিবারের সঙ্গে বসে দেখার কোনো সুযোগই নেই। সিরিজটির শেষের দিকে পপ এবং ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের ছোয়া তো দূর নায়িকার উপস্থিতিই সরিয়ে দেওয়া হয়। লেখার ক্ষেত্রে এসব খামতি এড়িয়ে যাওয়া দায়।
শ্রীরাম গণপথী র চলচ্চিত্রশিল্প সত্যিই খুবই সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এডিটিং এ লিড রোল রাধে র মাস্কড ম্যান এর থিওরী এবং তার উপস্থাপনা কে দুর্বল ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে মনমাতানো গানের যুগলবন্দী টি সত্যিই অবিস্মরণীয়। সেটা যদি নাই দেখলেন তাহলে কি দেখলেন প্রশ্ন করতে হয়। সঙ্গীত জগতের তিন অনবদ্য সৃষ্টিকর্তা কর্তা সংকর মহাদেভান, এহসান এবং লয়ের হাত ধরেই এই সিরিজের যে উত্থান। তাদের গাওয়া প্রত্যেকটি রাগের মধ্যে যে আলাদাই আবেগ, অনুভূতি,বেদনা,বিরহ,প্রেমের স্পর্ধা প্রকাশ পেয়েছে যা সত্যিই না শুনে বোঝা সাধ্যের বাইরে।