রুকস্যাক
ভিন্ন ভ্রমণ : জোনাকির জনপদে
দেবস্মিতা ঘােষ : গ্রামটির নাম পুরুষওয়াদি। মহারাষ্ট্রের আহমেদ নগরের দুই নদী কুরকুন্ডি ও মুলার। দুই নদীর মাঝে সবুজ চাদরে ঢাকা ছােট্ট একটি গ্রাম। বিভিন্ন পর্যটন সংস্থার সূত্র থেকে জানা যায়, বর্ষার শুরু অথাৎ জুন মাস নাগাদ এখানে সন্ধে হলেই বসে আলাের মেলা। জ্বলতে দেখা যায় হাজার হাজার জোনাকি।এই সময়ে প্রায় দু’ হাজার প্রজাতির জোনাকি দেখতে পাওয়া যায় এই গ্রামে। গত কয়েক বছর ধরে এখানে আয়োজিত হচ্ছে জোনাকি উৎসব বা ফায়ার ফ্লাইস ফেস্টিভ্যাল, যা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে চলেছে।
একবিংশ শতাব্দীতে পরিবেশের বিপর্যস্ত রূপ যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চেতনাকে চিন্তিত করে তােলে একথা আজ অকপটে স্বীকার্য। আজ সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে মানুষ তার চিন্তাশক্তি এবং মননশীলতা দিয়ে সমস্যার ফাঁকফোকড় খুঁজে মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে মানুষ প্রকৃতির এই নগ্ন রূপের মোহময়ী সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ, স্থানীয় মানুষ এবং সংস্কৃতির সুস্থিত উন্নয়ের কথা মাথায় রেখে পরিবেশ মিত্র পর্যটন গড়ে তুলতে সচেষ্ট। শহুরে জীবনের শোরগোল থেকে সামান্য কিছু দূরে প্রকৃতি এখানে একা। তাই হোমস্টে, স্থানীয় খাবার, স্থানীয় সংস্কৃতিসমস্ত কিছুকে হাতিয়ার করে ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তােলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
মুম্বাই বা পুনে থেকে নাসিক যাওয়ার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথেই পড়ে আদিবাসী অধ্যুষিত এই গ্রাম। মুম্বাই থেকে পুরুষওয়াদির দূরত্ব মাত্র ১৯০ কিমি। নিকটতম রেল স্টেশন ইগাতপুরী থেকে ৭১ কিমি পথ অতিক্রম করে খুব সহজেই পৌছে যাওয়া যায় পুরুষওয়াদি।
গ্রাসরুট নামে এক সংস্থা স্থানীয় গ্রামবাসীদের সহায়তায় পুরুষওয়াদির নির্জন গ্রাম্য পরিবেশের প্রশান্তি উপভােগ করার জন্য ক্যাম্পের তাঁবুতে অভিনব রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করেছে। এখানে পৌঁছানো মাত্রই ঐতিহ্যবাহী মারাঠি কায়দায় গুলাল টিক্কা এবং গান্ধি টুপিতে অভিনন্দন হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দুপুরের মারাঠি ভােজ যে এক অভিনব অভিজ্ঞতা সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। বিকাল বেলা পাহাড়েরঢালে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের সৌন্দর্যও নয়নাভিরাম। এই তাঁবু থেকেই আপনি সাক্ষী হতে পারেন জোনাকি উৎসবের। ভারী বর্ষার আগেই এই জোনাকিরা তাদের কয়েক দিনের জীবনযাপনে উন্মুখ হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীদের মতে, পুরুষ জোনাকি তাদের আলাের নাচনে প্রলাভিত করে স্ত্রী জোনাকিদের। আর দু’মাস ধরে চলে এই আলাের খেলা—মে এবং জুন।
ডিম ফুটে বেরিয়ে এসে স্ত্রী জোনাকিকে আকৃষ্ট করে পুরুষ জোনাকিরা এবং প্রজননের পর মারা যায়। পূর্ণতার হাজার রূপের আনন্দের ঝলকানিতে মােহময়ী রূপে সেজে ওঠে প্রকৃতি। আর এই বিরলতম দৃশ্যেরসাক্ষী হতে গেলে সবথেকে ভালাে সময় জুন মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ। বর্ষার আরম্ভে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে শুরু হয় জোনাকিদের সঙ্গী খোঁজার পালা। এ যেন বর্ষার সোঁদা মাটির গন্ধে বসন্তের পূর্ণতা প্রাপ্তির আভাস। কী বিচিত্র প্রকৃতির নিয়ম। কাছের নদীতে স্নানের সুযােগ, নগ্ন প্রকৃতির বুকে স্থানীয় ফল ও খাবার, গ্রাম্য সংস্কৃতি, পাহাড়ি জঙ্গলে ছােট ছােট ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা, সবশেষে এই অপূর্ব আলাের উৎসব ফায়ার ফ্লাইস ফেস্টিভ্যাল পর্যটকদের ভারতের বুকে ডিজনিল্যান্ডের সৌন্দর্য উপভােগের সুযােগ করে দেওয়ার দাবি রাখে।
প্রকৃতির সঙ্গে একান্তে কয়েকটি দিন, তবে আর কী ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হলে শহুরে রােজনামচা ফেলে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ুন পুরুষওয়াদির উদ্দেশে। ২৫শে মে থেকে ২৩ শে জুনের মধ্যে পুরুষওয়াদিতে হাজির থাকলেই আপনি সাক্ষী হতে পারবেন ফায়ার ফ্লাইস ফেস্টিভ্যালের বা জোনাকি উৎসবের।
রুকস্যাক
ভ্রমণ : বাগুরানের বেলাভূমিতে।
দেবস্মিতা ঘোষ : বাতাসে শীতের আমেজ, সোনালী রোদের অকৃত্রিম স্নেহে আগলে নেওয়া স্বভাব, সুনীল আকাশ সবে মিলে প্রকৃতি যেন কোল পেতে বসে দুবাহু বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আর আপনিও বুঝি নাগরিক ঘোড়দৌড়ে বিধ্বস্ত ????
বেশি নয়, ব্যস্ততার চোখরাঙানি থেকে এক কি দুই দিনের ছুটি বন্দোবস্ত করতে পারলেই মিলবে মুক্তির আস্বাদ। দিগন্তজোড়া নীলের মেলবন্ধন, চোখের পাতায় নেমে আসা বালির চড়, গর্জনরত সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝে একান্তে অবসার কাটাতে পৌঁছে যান পূর্ব মেদিনীপুরের বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্র তটে।
কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে বা হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন এ কাঁথি পৌঁছে যান। কাঁথি থেকে টোটোতে ২৫০-৩০০ টাকার বিনিময়ে প্রায়ে ২৪ কিমি পথ অতিক্রম করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্রতীরে। সমুদ্র এখানে শান্ত।
আর একটি অভিনব বিষয় হল জোয়ারের সময় সমুদ্র তীরের অনেক কাছে চলে আসে আবার ভাটার সময় অনেক দূরে চলে যায়। সারা তত জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় লাল কাঁকড়ার অবাধে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলা। সমুদ্রে সূর্যোদয় সাক্ষী থাকা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাই হাতে ছুটি একদিন বেশি থাকলে একদিন থেকে যাওয়ায় ভালো।
দিঘা, মান্ডারমনি বা জুনপুটের মতো পর্যটন এর ঘেরাটোপ বগুরান কে গ্রাস করেনি এখনো। তাই অফবিট এ নিরিবিলি ছুটি কাটানোর সেরা ঠিকানা হল বগুরান। জুনুপুট সমুদ্রতীর, দরিয়াপুর, কপালকুণ্ডলা মন্দির কাছাকাছির মধ্যেই ঘুরে দেখে নেয়া যায়। এখান থেকে আপনি আশে পাশের সমুদ্রসৈকত গুলিও ঘুরে আসতে পারেন যেমন বাঁকিপুট, দিঘা, মান্ডারমনি, তাজপুর।
তবে এখানে রাত্রিবাসের একমাত্র ঠিকানা হলো হোটেল সাগর নিরালা। কারণ খুব বেশিদিন হয়নি বগুরান বাংলার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। শহুরে জীবন যেসমস্ত সুবিধায় অভ্যস্ত সেই সব রকম সুবিধা এবং তিনবেলার আহার নিয়ে রাত্রিবাসের খরচ মোটামুটি কমবেশি ১০০০ টাকা।
এই শীতে তবে উইকেন্ডে প্ল্যান করেই ফেলুন বগুরান জলপাই সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে বালিতে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে কেটে, কিংবা লাল কাঁকড়ার দল কে গর্ত অবধি ধাওয়া করে, কিংবা আবার ভোরের আধো আলোয় প্রিয়জনের সাথে ঝিনুক কুড়িয়ে দারুন কাটবে ছুটির দিনগুলো।