কলমের আঁচড়ে
একই দেশের দুই নাগরিকের গল্প।
সৌমেন্দু বাগ :দুজন ভারতীয়। একজনের বয়স চৌত্রিশ বছর, ছেলে, পেশায় অভিনেতা; আরেক জনের উনিশ, মেয়ে, তেমন কিছু পেশা নেই। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই বাবা-মা কে চাষের কাজে সাহায্য করে। অভিনেতার রহস্যজনক মৃত্যু হয় ব্রান্দ্রার ফ্ল্যাটে, মেয়েটিকে চাষের খেতে গণ ধর্ষণ ও অত্যাচারের দু’সপ্তাহ পর হাসপাতালে মৃত্যু হয়। দুটি মৃত্যুই খুব দুঃখজনক। কিন্তু গল্প শুরু এর পর থেকে।
অভিনেতার মৃত্যুর দিন থেকে শুরু করে টানা তিন মাস দেশের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমে এই একটা খবরই চলেছে, ওই মেয়েটির ধর্ষণের পর, মৃত্যু না হওয়া অবধি আমরা কেও জানতেও পারেনি আর মৃত্যুর রাতেও প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমে সে খবরের খোঁজ নেই।
অভিনেতার মৃত্যু হলে সংবাদ মাধ্যম তাঁর বাবা-মা এর কাছে পৌঁছে যান, তাঁরা কোনো একজনকে এর জন্য দায়ী বলেন, দাবি করেন ন্যায়ের। স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়েটির মৃত্যু হলে তাঁর বাবা-মা -দাদা পুলিশের গাড়ির সামনে মাথা কুটে, কান্নাকাটি করেও মেয়েকে শেষবারের জন্য চোখে দেখতে পান না। মেয়েটির শেষ কৃত্য করার সুযোগ টুকুও পান না তাঁর কোনো আত্মীয়। সংবাদ মাধ্যমকে তাঁর মুখ অস্পষ্ট করেদিতে হয়।
অভিনেতার মৃত্যু হলে গোটা দেশে প্রায় আন্দোলন শুরু হয়ে যায়, তাঁর মৃত্যুর তদন্ত হোক। অমুক কে গ্রেপ্তার করা হক।অভিযুক্তের বাড়িতে রীতিমতো হামলা হয়, রাজ্যের সরকার প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।মাঠে নেমে পড়ে দেশের বৃহত্তম গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। গোটা অভিনয় জগতের সব ‘ধান্দাবাজি’ ফাঁস হতে শুরু করে। অভিযোগের তীর শুধু একজনে সীমাবদ্ধ থাকে না। আর মেয়েটির মৃত্যু হলে রাতারাতি পুড়িয়েদেওয়া হলো দেহ( হ্যাঁ, পুড়িয়ে দেওয়াই বলবো, কারণ ওকে শেষ কৃত্য বলে না।)। দাদা অভিযোগ করতে গেলে বলে আপনাদের মেয়ে বড্ড জ্বালাচ্ছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে যান। পুলিশ চিতার কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেন না। হাসাপাতালের রিপোর্টে ধর্ষন ও অত্যাচারের কোনো উল্লেখ থাকে না। প্রশাসন বলেন সবার সহযোগীতা নিয়েই শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। শান্তি অবস্থা বজায় আছে। ওদিকে বাড়িতে অসহায় বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, হতভাগী আমাদের শান্তি দিলো না!
অভিনেতার মৃত্যুর নাকি সবথেকে বড় সমব্যথী নিজেকে মুম্বাই শহরে ‘অসুরক্ষিত’ মনে করলে তার জন্য ‘ওয়াই+’ মানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আর ওদিকে একজন দলিত কিশোরী কে গণ ধর্ষণ করে জিভ কেটে দেওয়া হয়, তার বাবা মা কে শেষকৃত্য করতে দেওয়া হয় না। তার দাদা বলেন যেকোনো মুহূর্তে তাঁদের উপর আক্রমণ হতে পারে।
অভিনেতার মৃত্যু হলে এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অভিনেতার বাড়ি গিয়ে পরিবারের লোকেদের সাথে কথা বলেন। ন্যায় বিচারের প্রতিশ্রুতি দেন। মেয়েটির মৃত্যু হলে খবর আসে মুখ্যমন্ত্রী নাকি বাবা মা এর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেছেন, তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
অভিনেতার মৃত্যু হলে একটি রাজনৈতিক দল ‘তাঁর মৃত্যু ভোলা যাবে না’ লিখে পোস্টার ছাপায়। কিশোরীর মৃত্যু হলে রাজনীতিক মধ্যে শুরু হয়ে যায় কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। এই ছিল একই দেশের দুই নাগরিকের গল্প।
কলমের আঁচড়ে
পৃথিবীর বুকে মেনে চলা কিছু বিস্ময়কর এবং ভয়ঙ্কর সত্কার-রীতি!
বিশ্বজিৎ দাস : কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলে গেছেন “জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে?” অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করলে আমাদের মৃত্যু অনিবার্য। মানুষের মৃত্যুর পর সৎকার করা হয়। সভ্যতার প্রথম দিক থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। এই সৎকারের সময় টা খুবই কঠিন, বিশেষত নিকটজনের কাছে। সে সব আঁকড়ে থাকে, কারণ একবার ছেড়ে দিলে আর পাওয়া যাবে না। এই ভাবাবেগ থেকেই স্মৃতি রক্ষার ভাবনা শুরু। মৃতের ব্যবহৃত জিনিস রেখে দেওয়া, যেমন চুল কিছুটা কেটে যত্ন করে রেখে দেওয়া ছিল পুরনো প্রথা। অনেকে দাঁত সংরক্ষন করত। বুদ্ধের দাঁত কলকাতার জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে আজও।
কিন্তু পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির মধ্যেই মৃত্যুর পর কিছু বিশেষ নিয়ম পালন করার রীতি আছে। কিছু নিয়ম বিজ্ঞানসম্মত আবার কিছু একেবারে অদ্ভুত। মৃতদেহ সত্কারের জন্য কেউ যেখানে মৃতদেহটি পুড়িয়ে ফেলেন, আবার কেউ বা মাটিতে কবর দেন। আবার কেউ বা সযত্নে সেটিকে কফিনজাত করেন। কিন্তু এসবের বাইরেও এমন অনেক রীতিনীতি আছে যেগুলি আমার আপনার স্বাভাবিক ভাবনা চিন্তার বাইরে।
সাধারণ মানুষের কাছে মৃত ব্যক্তিকে মাটিতে কবর দিয়ে রাখা বা আগ্নিদাহ করা পরিবেশগত কারণে মোটামুটি স্বাভাবিক মনে হলেও কিছু কিছু সংস্কৃতিতে মৃত ব্যক্তি সমাহিত করার পদ্ধতি অবাক করার মতো।
পৃথিবী জুড়ে চলা এই আশ্চর্য ও কিছুটা ভয়ঙ্কর মৃত্যু অনুষ্ঠান গুলি হল :
১. মমিফিকেশন :
এই ঘটনা আমার আপনার কিছুটা জানা। প্রাচীন মিশরের ফারাওদের মরদেহ মমি করে সমাহিত করা হতো। এই পদ্ধতিতে প্রথমে দেহের অভ্যন্তরীণ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করা হয়। এরপরে দেহের সব আর্দ্রতা অপসারিত করা হয়। শেষে লম্বা আকৃতির লিনেন কাপড় দিয়ে দেহ মুড়ে ফেলা হয়।
তবে আধুনিক মমিফিকেশন পদ্ধতি আলাদা।বর্তমানে মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য কিছু রাসায়নিক তরল ভর্তি পাত্রে দেহ ডুবিয়ে রাখা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটি মৃতদেহ সৎকারের কোনো রীতি নয়; এটি মৃতদেহ সংরক্ষণ পদ্ধতি।
২. মৃতের পুনর্জাগরণ :
এই অদ্ভুত প্রথাটি পালন করা হয় মাদাগাস্কায়। প্রতি পাঁচ থেকে সাত বছর পর পর। তার নিকটাত্মীয়রা কবর খুঁড়ে মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষ বের করে আনে। এরপর মৃত ব্যক্তিকে নতুন পোশাক পরানো হয় এবং পারিবারিক ভোজে তাকে বসিয়ে রাখা হয়।এদিন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে গানের তালে তালে নাচতেও দেখা যায়। পারিবারিক পুনর্মিলন হিসেবে প্রথাটিকে দেখা হয়।
৩. এন্ডোক্যানিবালিজম (Endocannibalism) :
এই বিশেষ মৃত্যু অনুষ্ঠানটি দেখতে পাওয়া যায় আমাজন রেইন ফরেস্টের ইয়ানোমমি উপজাতি, পাপুয়া নিউ গিনির মেলানসিয়ানস উপজাতি এবং ব্রাজিলের ওয়ারীরা উপজাতির মধ্যে।এখানে একটি মৃতদেহকে বা দেহাংশকে ভক্ষণ করা হয়। তাদের বিশ্বাস এই প্রথার মধ্যে দিয়ে মৃত ব্যাক্তির আত্মা স্বর্গে যাবে।
এই জাতির মানুষেরা বিশ্বাস করেন, মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। উপরন্তু তারা ভাবেন যে, তাদের প্রতিদ্বন্দী গোষ্ঠী কোনো অশুভ আত্মাকে প্রেরণ করেছে। সেই কারণে এই ঘটনা রোধ করার জন্য তারা এই অনুষ্ঠানটি করে থাকেন। যাতে মৃত ব্যাক্তির আত্মা জীবিত থাকে এবং তার পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারে।
এই অনুষ্ঠানটি করার জন্য প্রথমে তারা মৃতদেহটিকে পাতা দিয়ে মুড়ে বাড়ি (যেখানে তিনি মারা গেছেন) থেকে অল্প দূরে জঙ্গলে রেখে আসেন। এর পর মোটামুটি ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মাথায় সেই পঁচাগলে যাওয়া মৃতদেহ থেকে হাড় সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। এরপর কলা দিয়ে বানানো একধরণের সুপের মধ্যে মৃতদেহের ছাই মিশিয়ে গোষ্ঠীর সকলে সেটি পান করে। তবে এই নিয়ম শুধুমাত্র গোষ্ঠীর শিশু ও মহিলারা পালন করেন।
৪. তিব্বত বৌদ্ধ মহিমা কবর/ তিব্বতের আকাশ সৎকার (Tibetan Buddhist Celestial Burials or Sky burial) :
এই সৎকার অনুষ্ঠানটি তিব্বতি ঐতিহ্যের প্রতীক। এই অনুষ্ঠানে মৃতদেহকে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে পাহাড়ের মাথায় রেখে আসা হয় এবং পাখিদের (বিশেষত শিকারী পাখিদের) ওই দেহাংশ ভক্ষণ করতে দেওয়া হয়। অনেক সময় অক্ষত মৃতদেহও রেখে দেওয়া হয় এই পাখিদের খাদ্য হওয়ার জন্য।
বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে মৃতদেহকে খালি জাহাজ মনে করা হয় যা সংরক্ষনের কোনো দরকার নেই।মূলত, তিব্বতের কঠিন জলবায়ু ও পাথরে ভরা জমিতে কবর দেওয়া এক পক্ষে অসম্ভব।৫. সাসপেন্ড কবরস্থান (Suspended Burials) : এই সৎকার অনুষ্ঠানটি প্রাচীন চীন বংশের মধ্যে দেখা যায়। এখানে তারা মৃতদেহকে কফিনে পুড়ে উঁচু পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত শিলার উপর ঝুলিয়ে রেখে দেয়। সাধারণের বিশ্বাস, মৃতদেহকে আকাশের কাছাকাছি রাখা উচিত যাতে তারা বন্য প্রাণীদের নাগালের বাইরে এবং ভগবানের নাগালের মধ্যে বা কাছাকাছি থাকতে পারে।
৫. সতী :
উপযুক্ত কারণেই হিন্দু ধর্মে সতীদাহ প্রথার প্রচলন বর্তমানে নিষিদ্ধ। তবুও একটা সময়ে এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক সৎকার হিন্দু ধর্মের এক সনাতনী ঐতিহ্য হিসাবেই মানা হত। এই রীতি অনুযায়ী, মৃত ব্যাক্তির স্ত্রী কে বধূবেশে সাজিয়ে একই চিতায় মৃত্যু বরণ করতে হত। সেই সময় দাবি করা হত, সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে মৃত স্ত্রী সতিরূপে স্বর্গলাভ করবে।
৬. ভাইকিং ফিউনারেল (The Viking Funeral) :
এটি একটি অন্যতম নৃশংস সৎকার অনুষ্ঠান। এই রীতি অনুযায়ী মৃতদেহকে একটি অস্থায়ী কবরে দশ দিনের জন্য রাখা হত। পাশাপাশি চলত মৃতের জন্য নতুন জামাকাপড় তৈরির কাজ। অন্যদিকে একজন ক্রীতদাসীকে বেছে নেওয়া হত, যে ওই মৃত মানুষটির পরবর্তী জীবনের সঙ্গিনী হবে। এরপর সেই মেয়েটি ওই গ্রামের সকলের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতো। তাদের মতে এই বর্বরতায় নাকি ছিল মৃতব্যাক্তির প্রতি প্রেম নিবেদন। তারপর ওই দাসীর গলায় ফাঁস দিয়ে এবং সবশেষে ছুরি মেরে হত্যা করা হতো।
এরপর একটি কাঠের জাহাজে মৃত ব্যাক্তির সাথে তাকেও রেখে দিয়ে অগ্নি সংযোগ করা হত।
৭. আঙুলের আবৃততা (Ritual Finger Amputation) :
এই মৃতদেহ সৎকারের নিয়মটি পাপুয়া নিউ গিনির দানি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত।
এই নিয়ম অনুযায়ী বাড়ির কোনো প্রিয় ব্যক্তি মারা গেলে তার সঙ্গে সম্বন্ধিত মহিলা ও শিশুরা তাদের আঙুলের কিছু অংশ কেটে ফেলত। এরপর কাদা ও ছাই মুখে মেখে মৃতব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশ করত।
৮. টোটেম পোলস (Mortuary Totem Poles) :
স্থানীয় সভ্যতার বিভিন্ন গল্প তুলে ধরার জন্য টোটেম পোল তৈরি করা হয়। হায়দা উপজাতির মধ্যে এই রীতি দেখতে পাওয়া যায়। এই রীতি অনুযায়ী মৃতব্যাক্তির শরীরকে পেটানো হবে যতক্ষন না এটি একটি ছোট বাক্সে এঁটে যায়।এরপর এই বাক্সটি একটি টোটেম পোল এর উপর রেখে মৃত ব্যাক্তির বাড়ির সামনে রেখে আসা হয়।
৯. বারিড ইন ফ্যান্টাসি কফিন (Buried in a fantasy Coffin) :
এই রীতি অনুযায়ী মৃতদেহকে এমন একটি কফিনে রাখা হয় যেটি তার জীবনকে অথবা পেশাকে উপস্থাপনা করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বিমান চালক কে বিমানরূপী কফিনে, কোনো জেলেকে মাছরূপী কফিনে আবার কোনো ধনী ব্যাবসায়ীকে একটি দামি গাড়ীরূপী কফিনে রাখা হয়।
১০. অন্ধ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া (Blindfolded funeral) :
এই মৃতদেহ সৎকারের রীতি অনুযায়ী মৃতদেহের চোখ বেঁধে তাকে বাড়ির মুখ্য দরজার সামনে রেখে দেওয়া হয়। এটি দেখা যায় উত্তর পশ্চিম ফিলিপিনেসে।
এছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে আরও নানান ধরনের অদ্ভুত এবং ভয়ংকর সৎকার অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া যায়।