রুকস্যাক
আমার চোখে দিল্লী – আগ্রা (পর্ব – ৫)
পর্ব ৫, তাজমহল
রীতা বসু : আগ্রা ফোর্ট থেকে বেরিয়ে ছুটলাম তাজমহল দেখতে। সূর্য্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পরেছে, সময় কম।অটোওলা বলেছিল তাজ দেখতে হয় সূর্যাস্তের অথবা সূর্যোদয়ের অথবা চাঁদের আলোতে নইলে তার সৌন্দর্য্য পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় না। সেইমত আমাদের অটো ছুটল তাজমহলের দিকে।কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।আমরা তাজের গেটের হাত কয়েক দূরে থেকে দেখলাম গেট বন্ধ হয়ে গেল। অটোওলা বলে দিয়েছিল দক্ষিন দ্বার বন্ধ হয়ে গেলে পশ্চিম দ্বারে চলে যেতে। কোথায় পশ্চিমদ্বার, সেখানে যাবার পথ কোথায় আমরা কিছুই জানি না। অবশেষে গাইডের পরামর্শ অনুযায়ি তার হাতেই সব কিছু ছেড়ে দিলাম। সে-ই আমাদের টিকিট ও ঢোকার ব্যবস্থা করে দেবে।
গাইডকে অনুসরন করে ছুটছি, এদিক ওদিক তাকাবার ফুরসত নেই,মনে একটাই আশা তাজমহল দেখব। গলির গলি তস্য গলি দিয়ে ছুটছি।শেষ গলিটাতে তো দুপাশের বাড়ির দেওয়াল গায়ে লাগে আর কি।মাথার উপরে পবন নন্দনরা লাফিয়ে লাফিয়ে পরমানন্দে একছাদ থেকে অন্য ছাদে যাচ্ছে। অবশেষে এসে দাঁড়ালাম এক ভয়ানক সিঁড়ির সামনে। সিঁড়িটি হাত দুয়েক চওড়া।বাইরের যতটুকু আলো আছে তার সামান্যই পৌঁছেছে এখানে। সিঁড়ির ধাপ যে ক’টা তাও বোঝার উপায় নেই কারন সেটা এমন খাড়াই যে প্রথম গোটা তিনেক ধাপের পর আর দেখা যাচ্ছে না।মশৃন পাথরের ধাপ গুলি এত সংকির্ন যে পা সোজা ভাবে ফেলা যাবে না। দেওয়ালে একহাত দিয়ে সাপোর্ট দিয়ে অন্যহাতে গাইডকে ধরে নামতে লাগলাম।গাইড একধাপ নামে পরে আমি একধাপ নামি এই ভাবে বেশ কসরত করে দুরুদুরু বুকে নেমে এলাম সমতলে।
এবার চেকিং,সেও এক সমস্যায় ফেলল।প্রথমে স্ক্যানিং হলো আমাদের ব্যাগ তারপর ব্যাগের ভিতরে হাত দিয়ে উল্টে পালটে দেখা হলে বেরিয়ে পরল দুটো মাঝারি সাইজের চকোলেট।ব্যস,সিকিউরিটি ওগুলো হস্তগত করল।
তাজমহলের বাইরের সৌন্দর্য্য বর্ননা প্রথম পর্বে করেছি,এখানে তার আর পুনরাবৃত্তি করলাম না।ভেতরে ঢুকে আশাহত হলাম। মমতাজ বেগম ও সম্রাট সাজাহানের আসল সমাধি তো দেখার উপায় নেই-ই উপরে যে রেপ্লিকা আছে তার কাছে যাওয়ার ও উপায় নেই। রেলিং দিয়ে এমন ভাবে সুরক্ষিত যে ফাঁকফোঁকর দিয়ে দেখতে হচ্ছে। সমাধি ঘেরা জাফরির মধ্য দিয়ে দেখলাম সমাধি।সামনের দিকে দড়জার রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে ভাল করে দেখার চেষ্টা করেছিলাম ভীড়ের চাপে আর সিকিউরিটির তাড়াতে তাও সম্ভব হলো না।ভিতরে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে।আলোর ব্যবস্থা না থাকায় ছবিও তুলতে পারলাম না।খুব ইচ্ছা ছিল কহিনুর হীরা বসাবার স্থানটি দেখার। মনোবান্ছা পূর্ন হলো না।
এবার কহিনুর হীরা সমন্ধে একটু জানা যাক।গোয়ালিয়রের রাজা এটি সম্রাট বাবরকে উপঢৌকন দিয়েছিলেন। বলা হয় তখন এর যা মূল্য ছিল তার অর্ধেকে গোটা পৃথিবীর মানুষকে একদিন পেট পুরে খাওয়ান যেত।অবশ্য তখন জনসংখ্যাও কম ছিল। বংশানুক্রমিক ভাবে কহিনুর হীরা সম্রাট সাজাহানের হাতে আসে আর তিনি তা তাজমহলের শোভা বর্ধনের কাজে লাগান। তারপরের ইতিহাস তো সকলের জানা।
তাজমহল থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম মিনাবাজার।এখানে দেখলাম স্থানিয় জেলের কয়েদিদের তৈরী রেজাই ও বাঁশের আঁশ থেকে তৈরী সূতোয় বোনা শাড়ি। ওগুলো কেনার কথা ভাবি নি। পাশেই পাথরের তৈরী জিনিসের দোকান থেকে ছোটো খাটো কিছু পাথরের জিনিস কিনলাম।এবার হোটেলে ফেরার পালা। রাতটুকু বিশ্রাম নিয়ে কাল যাব ফতেপুর সিক্রি দেখতে।তার আগে ফতেপুরের কিছু ইতিহাস জেনে নেব।
মোগল সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট বাবর যাঁর পুরো নাম জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। ফার্সী বাবর শব্দের অর্থ শের। তিনি ছিলেন ফরমানের শক্তিশালী রাজা, কাবুল ও কান্দাহার ছিল তাঁর অধীন। এদিকে দিল্লীর শাশক তখন ইব্রাহিম লোদী।কয়েক জন রাজপুত রাজা ইব্রাহিম লোদীর শাশনে সন্তুষ্ট ছিলেন না অথচ তাঁদের মিলিত শক্তিও ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত করতে যথেষ্ট ছিল না। তাঁরা বাবরকে আহ্বান করেন দিল্লী আক্রমন করবার জন্য। চুক্তি হয় বাবর দিল্লী জয় করে লুটপাট করে দেশে ফিরে যাবেন। মরুভূমি পার হয়ে বাবরের বিশাল সৈন্য বাহিনী দিল্লী আক্রমন করে। ইব্রাহিম লোদী পরাস্ত হন।যথেচ্ছ লুটপাট করে বাবর সবকিছু সৈন্যদের মধ্যে বিতরন করে দেন কারন বিরাট মরুভূমি পেরিয়ে আসতে তারা অনেক কষ্ট স্বীকার করেও জয়ী হয়েছে। বাবর প্রথম সমুদ্র দেখেন এই ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষের পাহাড়, সমুদ্র, নদী ও সমতলের এমন মিশ্রন তাঁকে মুগ্ধ করে। চুক্তিমতো ফরমানে ফিরেগিয়েও বাবর শান্তি পান না। আবার দিল্লী আক্রমন করেন ও রাজত্ব বিস্তার করেন। কয়েকজন রানা বাবরের অধিনতা স্বীকার করতে পারেন নি তাঁদের মধ্যে ছিলেন রানা সাঙ্গা একজন।চিস্তি গ্রাম ছিল তাঁর অধীনে।বাবরের সাথে রানা সাঙ্গার তুমুল যুদ্ধ হয় এই চিস্তিতেই।বাবরের সৈন্যবলের কাছে রানা সাঙ্গার সৈন্যদল অনেক দুর্বল ছিল। তবু তিনি দুজন বীর পরাক্রমশালী সেনাপতির সাহায্যে শেষ পর্যন্ত লড়ে যান কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। রানা সাঙ্গার পরাজয়ের পর পুরো এলাকার নাম হয় ফতে পুর সিক্রি। বিজয়ী সম্রাট বাবর তাঁর বিজয়ের স্বারক হিসাবে বুলন্দ দরোয়াজা নির্মান করেন এবং দরোয়াজার দুদিকে রানা সাঙ্গার বীর দুই সেনাপতির ঘোড়ায় চড়া মর্মর মূর্তি স্থাপন করেন, কালের নিয়মে সেই মূর্তি আজ ধ্বংস প্রাপ্ত।অনেক ঐতিহাসিকের মতে বুলন্দ দরোয়াজা সম্রাট আকবর নির্মান করেন গুজরাট জয়ের পর। বুলন্দ দরোয়াজা দিয়ে একমাত্র সম্রাটই দূর্গে প্রবেশ করতে পারতেন, আম জনতার সেই অধিকার ছিল না। সেই নিয়ম আজও চলে আসছে পর্যটকরা বুলন্দ দরোয়াজা দিয়ে দূর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন প্রবেশ অন্য দ্বার দিয়ে।
রুকস্যাক
ভ্রমণ : বাগুরানের বেলাভূমিতে।
দেবস্মিতা ঘোষ : বাতাসে শীতের আমেজ, সোনালী রোদের অকৃত্রিম স্নেহে আগলে নেওয়া স্বভাব, সুনীল আকাশ সবে মিলে প্রকৃতি যেন কোল পেতে বসে দুবাহু বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আর আপনিও বুঝি নাগরিক ঘোড়দৌড়ে বিধ্বস্ত ????
বেশি নয়, ব্যস্ততার চোখরাঙানি থেকে এক কি দুই দিনের ছুটি বন্দোবস্ত করতে পারলেই মিলবে মুক্তির আস্বাদ। দিগন্তজোড়া নীলের মেলবন্ধন, চোখের পাতায় নেমে আসা বালির চড়, গর্জনরত সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝে একান্তে অবসার কাটাতে পৌঁছে যান পূর্ব মেদিনীপুরের বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্র তটে।
কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে বা হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন এ কাঁথি পৌঁছে যান। কাঁথি থেকে টোটোতে ২৫০-৩০০ টাকার বিনিময়ে প্রায়ে ২৪ কিমি পথ অতিক্রম করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্রতীরে। সমুদ্র এখানে শান্ত।
আর একটি অভিনব বিষয় হল জোয়ারের সময় সমুদ্র তীরের অনেক কাছে চলে আসে আবার ভাটার সময় অনেক দূরে চলে যায়। সারা তত জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় লাল কাঁকড়ার অবাধে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলা। সমুদ্রে সূর্যোদয় সাক্ষী থাকা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাই হাতে ছুটি একদিন বেশি থাকলে একদিন থেকে যাওয়ায় ভালো।
দিঘা, মান্ডারমনি বা জুনপুটের মতো পর্যটন এর ঘেরাটোপ বগুরান কে গ্রাস করেনি এখনো। তাই অফবিট এ নিরিবিলি ছুটি কাটানোর সেরা ঠিকানা হল বগুরান। জুনুপুট সমুদ্রতীর, দরিয়াপুর, কপালকুণ্ডলা মন্দির কাছাকাছির মধ্যেই ঘুরে দেখে নেয়া যায়। এখান থেকে আপনি আশে পাশের সমুদ্রসৈকত গুলিও ঘুরে আসতে পারেন যেমন বাঁকিপুট, দিঘা, মান্ডারমনি, তাজপুর।
তবে এখানে রাত্রিবাসের একমাত্র ঠিকানা হলো হোটেল সাগর নিরালা। কারণ খুব বেশিদিন হয়নি বগুরান বাংলার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। শহুরে জীবন যেসমস্ত সুবিধায় অভ্যস্ত সেই সব রকম সুবিধা এবং তিনবেলার আহার নিয়ে রাত্রিবাসের খরচ মোটামুটি কমবেশি ১০০০ টাকা।
এই শীতে তবে উইকেন্ডে প্ল্যান করেই ফেলুন বগুরান জলপাই সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে বালিতে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে কেটে, কিংবা লাল কাঁকড়ার দল কে গর্ত অবধি ধাওয়া করে, কিংবা আবার ভোরের আধো আলোয় প্রিয়জনের সাথে ঝিনুক কুড়িয়ে দারুন কাটবে ছুটির দিনগুলো।