Connect with us

রুকস্যাক

আমার চোখে দিল্লী – আগ্রা (পর্ব – ৬)

Published

on

Social Update Bengali News Image
Image Source Twitter

পর্ব ৬, ফতেপুর সিক্রি 

রীতা বসু : পরদিন আমাদের গাড়ি বুক করা ছিল সেইমত আমরা সকাল আটটায় বেড়িয়ে পরলাম ফতেপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে।ঘন্টা দেড়েক পর আমাদের গাড়ি থামলো দূর্গ থেকে বেশ কিছুটা দূরে, তারপর আর তার যাবার অনুমতি নেই।এখানে থেকে গাইডের ঠিক করা অটোতে আরও কিছুটা গিয়ে আমাদের নামতে হলো।এখন দেড় কিলোমিটার মতো রাস্তা হাঁটতে হবে ৷ গাইড দূর্গের কাছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে বলে তার বাইকে উঠে চলে গেল।আমরা গজেন্দ্র গমনে রওনা হলাম। হাঁটতে খুব একটা কষ্ট হলো না সুন্দর রাস্তা,সামান্য চড়াই। কিছুটা গিয়ে দূর্গের প্রাচীর দেখতে পেলাম এবং ছবি নিলাম।অবশেষে পথ শেষ হল।সামনে দূর্গে ওঠার ভয়ানক খাড়া রাস্তা। ছোটো ছোটো রঙিন পাথর বসান রাস্তা ৷ উপর দিকে তাকালে মাথা ঘুরে ওঠে তাই পায়ের দিকে তাকিয়ে চলতে লাগলাম। অবশেষে পথ শেষ হলো, গাইডের নির্দেশিত লোকের কাছে জুতো জমা রেখে দূর্গদ্বারে এসে দাঁড়ালাম।দূর্গের ভিতরে সেলিম চিস্তির সমাধী মন্দির তাই এই দূর্গে জুতো পরে যাবার অনুমতি নেই।

কথিত আছে সেলিম চিস্তি ছিলেন চিস্তি সম্প্রদায়ের গুরু।তিনি ছিলেন দরিদ্রের ভগবান,তাঁর অাশির্বাদে অনেকের মনোবান্ছা পূর্ন হয় কিন্তু তিনি ধনী ব্যক্তিদের সাথে দেখা করতেন না।এদিকে সম্রাট আকবরের তখনও পর্যন্ত কোনো সন্তান ছিল না তাই সম্রাট আকবর সেলিম চিস্তির আশির্বাদ পেতে সাধারনের পোষাকে নিজের দুই বেগমকে নিয়ে খালি পায়ে আগ্রা ফোর্ট থেকে ফতেপুর সিক্রিতে আসেন।এখানে একটু সংশয় জাগে। আগ্রা ফোর্ট থেকে ফতেপুর সিক্রির দুরত্ব নেহাত কম নয়, অতোটা রাস্তা একজন সম্রাট ও দুজন মহিলার পক্ষে খালি পায়ে হেঁটে আসা কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ বিশেষতঃ তখন এমন সুন্দর রাস্তা ছিল কিনা সন্দেহ।সে যাক, আমরা গাইডের কথায় ফিরি।সেলিম চিস্তি ভালো পামিষ্টও ছিলেন। তিনি সম্রাটের হাত দেখে তাঁর ছদ্মবেশ ধরে ফেলেন ও ক্ষুব্ধ হন। সম্রাট তাঁর ক্ষমাপ্রার্থি হন ও সেলিম চিস্তিকে গুরু বলে মানেন ও তাঁর আশীর্বাদ প্রাপ্ত হন। অবশেষে গুরুর আশির্বাদে সম্রাজ্ঞী যোধাবাঈ পুত্র সন্তান লাভ করেন ও সেলিম চিস্তির নামানুসারে পুত্রের নাম হয় সেলিম। সেলিমের জন্ম ফতেপুর সিক্রিতেই।

অনেক ঐতিহাসিক বলেন যোধাবাঈ সম্রাট আকবরের বেগম নন তিনি সেলিমের বেগম।যেহেতু প্রথমা বেগমের পুত্রই রাজ্যের অধিকারী হন এবং সম্রাটের প্রথমা বেগম রুকাইয়া বিবি তখন বর্তমান তাই যোধাবাঈ এর ভাই মানসিং যিনি পরবর্তি কালে সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি হন সম্রাটের সাথে বোনের বিবাহ দিতে রাজি হন না তাই যোধাবাঈ এর সাথে সেলিমের বিবাহ হয়।সে যাই হোক আমরা বিতর্কে যাব না।এমনও হতে পারে দুই মহিলা একই ঘরানার এবং একই নামের অধিকারিনী।

দূর্গের ভিতরে সুন্দর কারুকাজ করা সাদা পাথরে তৈরী সেলিম চিস্তির সমাধি মন্দির।এছাড়া আরও অনেক সমাধি আছে কাছাকাছি, সেগুলো সবই সেলিমচিস্তির পরিবারের সদস্যদের সমাধি।বাইরে পুরুষদের আর ভিতরে মহিলাদের সমাধি। সমাধিগুলো টপকে টপকে আমরা এসে দাঁড়ালাম একটা সিঁড়ির কাছে। এখান থেকে দেখলাম সম্রাট আকবরের টাকশাল,ডাক হরকরার কাজে ব্যবহৃত পায়রাদের থাকবার ঘুলঘুলি।সম্রাট আকবরের হাতির সমাধি। শোনা যায় কোনো দোষীর দোষ প্রমানিত না হলে তাকে এই হাতির সামনে দেওয়া হতো,যদি সে প্রকৃতই দোষি না হতো তাহলে হাতি তাকে শুড় তুলে অভিবাদন করত আর দোষি হলে তাকে পায়ে পিষে মেরে ফেলত।এখানে একটা সুরঙ্গ দেখলাম জানলাম সুরঙ্গটি দিল্লী হয়ে লাহোর ফোর্ট পর্যন্ত বিস্তৃত।এই সুরঙ্গ পথেই সম্রাটের প্রথমা বেগম রুকাইয়া বেগম আনারকলিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন।সেলিম চিস্তির বংশধররা এখনও কেউ কেউ আছেন কাছেই একটা দোতলা বাড়িতে।এই সিঁড়ির কাছে আসবার আগে আমরা দেখেছি সম্রাট আকবরের তৈরী প্রথম মহিলাদের জন্য মাদ্রাসা ও ছাত্রী নিবাস।

এবার আমাদের সেলিম চিস্তির সমাধি মন্দিরে যেতে হবে।গাইড আমাদের দূর্গের মধ্যেই এক দোকানির কাছে নিয়ে এলো।এখান থেকে চাদর কিনে সেলিম চিস্তির সমাধিতে চড়ালে নাকি তাঁর অাশির্বাদে মনোবান্ছা পূর্ন হয়।চাদরের দাম আড়াইশ থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত।গাইডের কথানুসারে এই চাদর গরিবদের বিবাহের জন্য দেওয়া হয় আবার কিছু কাপড় দিয়ে জামা তৈরী করে গরিবদের মধ্যে বিতরন করা হয়।কেউ অসুস্থ হলেও এই কাপড়ের মাদুলি করে পরালে নাকি রোগ সেরে যায়। বাবা না ডাকলে তাঁর মাজার দর্শন হয় না।পরভেজ মুশারফ যখন ভারতে আসেন এখানে আসার ঠিক আগেই তিনি পা ভেঙে অসুস্থ হয়ে পরেন, তাঁর স্ত্রী একা এসে মাজারে চাদর চড়িয়ে যান।এখানে মাথা ঢেকে ঢুকতে হয়।গাইডের নির্দেশে আমরাও মাথা ঢেকে নিলাম।ভিতরে ছবি তোলা নিসিদ্ধ।

মাজার থেকে বেরিয়ে আবার তপ্ত চাতাল পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম বুলন্দ দরোয়াজার সামনে।দরজায় অগুন্তি ঘোড়ার নাল দেখিয়ে গাইড জানাল সম্রাট আকবরের সময় থেকে কোনো ঘোড়া অসুস্থ হলে বাবার মাজারে মানত করা হয় আবার ঘোড়া সুস্থ হলে তার একটি নাল এখানে লাগিয়ে দেওয়া হয়।

বুলন্দ দরোয়াজা পেরিয়ে আবার সেই তপ্ত চাতাল।সামনে চিস্তি গ্রাম।নীচে সম্রাটের হামাম যেখান থেকে স্নান সেরে সম্রাট গুরু দর্শন করে রাজকাজে যেতেন।তপ্ত চাতালে দাঁড়িয়ে সেই হামামের ছবি তোলা সম্ভব হলো না।দূর থেকে শুধু তার ছাদের ছবি নিতে পারলাম।

এবার যাব যোধাবাঈ মহল দেখতে। জুতো সংগ্রহ করে সেই খাড়াই পথে নেমে এলাম।এখন যদিও সেটা উৎড়াই।গাইড আমাদের যোধাবাঈ মহলের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে তার পাওনা নিয়ে বিদায় হলো আমরা এগিয়ে চললাম।

যোধাবাঈ মহলে যেতে খানিকটা হাঁটতে হবে ।যেতে যেতে আমরা কিছুটা ইতিহাস জেনে নেব। সম্রাট বাবর থেকে আরঙ্গজেব পর্যন্ত মোগল শাশন কিন্তু নিবরবচ্ছিন্ন ভাবে চলে নি।সম্রাট বাবরের পর সম্রাট হন তাঁর পুত্র হুমায়ুন।সেই সময় শের শা সুরি যাঁর পুর্ব নাম ছিল ফরিদ খান তিনি সম্রাট হুমায়ুনকে পরাস্ত করে দিল্লী দখল করেন। ঐতিহাসিকদের মতে সম্রাট হুমায়ুন প্রান বাঁচাতে ঘোড়া সমেত একটি খাদে লাফিয়ে পরেন।একজন ভিস্তিওলা তাঁকে উদ্ধার করে এবং এক রাজপুত রাজার কাছে হুমায়ুন আশ্রয় পান।ভিস্তিওলা সম্রাটের প্রান বাঁচাবার পুরস্কার স্বরূপ একদিনের রাজা হবার ইচ্ছা প্রকাশ করে।এই রাজপুত পরিবারে থাকা কালিন সম্রাট আকবরের জন্ম হয় এবং তাঁর শৈশব ও কৈশর কাটে এই রাজপুতদের সংস্পর্শে।তাই রাজপুতদের প্রতি সম্রাট আকবরের হৃদয়ে একটি কোমল স্থান ছিল। পরবর্তি কালে হুমায়ুন তাঁর কিছু বিশ্বস্ত অনুচর ও রাজপুতদের সহায়তায় শের শা সুরিকে পরাস্ত করে সাম্রাজ্য ফিরে পান। এও শোনা যায় হুমায়ুন প্রতিশ্রুতি মতো ভিস্তিওলাকে একদিনের জন্য রাজা করেন ও তার নামে চামরার মুদ্রা প্রকাশ করেন যদিও তার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় নি। আমরা পৌঁছে গেছি যোধাবাঈ মহলের কাছে এবার টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে হবে।

Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রুকস্যাক

ভ্রমণ : বাগুরানের বেলাভূমিতে।

Published

on

Social Update Bengali News Image

দেবস্মিতা ঘোষ : বাতাসে শীতের আমেজ, সোনালী রোদের অকৃত্রিম স্নেহে আগলে নেওয়া স্বভাব, সুনীল আকাশ সবে মিলে প্রকৃতি যেন কোল পেতে বসে দুবাহু বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আর আপনিও বুঝি নাগরিক ঘোড়দৌড়ে বিধ্বস্ত ????

বেশি নয়, ব্যস্ততার চোখরাঙানি থেকে এক কি দুই দিনের ছুটি বন্দোবস্ত করতে পারলেই মিলবে মুক্তির আস্বাদ। দিগন্তজোড়া নীলের মেলবন্ধন, চোখের পাতায় নেমে আসা বালির চড়, গর্জনরত সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝে একান্তে অবসার কাটাতে পৌঁছে যান পূর্ব মেদিনীপুরের বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্র তটে।

কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে বা হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন এ কাঁথি পৌঁছে যান। কাঁথি থেকে টোটোতে ২৫০-৩০০ টাকার বিনিময়ে প্রায়ে ২৪ কিমি পথ অতিক্রম করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্রতীরে। সমুদ্র এখানে শান্ত।

আর একটি অভিনব বিষয় হল জোয়ারের সময় সমুদ্র তীরের অনেক কাছে চলে আসে আবার ভাটার সময় অনেক দূরে চলে যায়। সারা তত জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় লাল কাঁকড়ার অবাধে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলা। সমুদ্রে সূর্যোদয় সাক্ষী থাকা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাই হাতে ছুটি একদিন বেশি থাকলে একদিন থেকে যাওয়ায় ভালো।

দিঘা, মান্ডারমনি বা জুনপুটের মতো পর্যটন এর ঘেরাটোপ বগুরান কে গ্রাস করেনি এখনো। তাই অফবিট এ নিরিবিলি ছুটি কাটানোর সেরা ঠিকানা হল বগুরান। জুনুপুট সমুদ্রতীর, দরিয়াপুর, কপালকুণ্ডলা মন্দির কাছাকাছির মধ্যেই ঘুরে দেখে নেয়া যায়। এখান থেকে আপনি আশে পাশের সমুদ্রসৈকত গুলিও ঘুরে আসতে পারেন যেমন বাঁকিপুট, দিঘা, মান্ডারমনি, তাজপুর।

তবে এখানে রাত্রিবাসের একমাত্র ঠিকানা হলো হোটেল সাগর নিরালা। কারণ খুব বেশিদিন হয়নি বগুরান বাংলার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। শহুরে জীবন যেসমস্ত সুবিধায় অভ্যস্ত সেই সব রকম সুবিধা এবং তিনবেলার আহার নিয়ে রাত্রিবাসের খরচ মোটামুটি কমবেশি ১০০০ টাকা।

এই শীতে তবে উইকেন্ডে প্ল্যান করেই ফেলুন বগুরান জলপাই সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে বালিতে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে কেটে, কিংবা লাল কাঁকড়ার দল কে গর্ত অবধি ধাওয়া করে, কিংবা আবার ভোরের আধো আলোয় প্রিয়জনের সাথে ঝিনুক কুড়িয়ে দারুন কাটবে ছুটির দিনগুলো।

Continue Reading
Advertisement
Advertisement
Advertisement e

আমাদের ফেসবুকে পেজ লাইক করুন

Advertisement
Advertisement

জনপ্রিয় পোস্ট