রিভিউ
“রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে আকুল চোখ আর মুখের মলিন…” মুভি রিভিউ: বুলবুল
সৌমেন্দু বাগ : “পিসিমা, নুপুর কেন পড়তে হয়?”“মেয়েদের পা কে বশে রাখতে।” এক চঞ্চল কিশোরীকে তার অভিভাবিকা বোঝাচ্ছেন।“বড় বড় প্রাসাদে বড় বড় গুপ্তকথা থাকে। চুপ থাকতে শেখ।” অসহায় তরুণীকে তার জা বোঝাচ্ছেন। এভাবেই বুঝে থাকে তারা, বুলবুলরা, কৈশোরত্ব পেরিয়ে যায় তারুণ্য এর দিকে। বোঝা শেষ হয় না। সমস্ত ভালবাসা -আশ্রয় ত্যাগ করে এসে তারা অচেনা , নির্জন প্রাসাদে একটু ভালোবাসার জন্য হাহাকার করে। শিকল আটকে দেওয়া সেই হাহাকার যখন বেরিয়ে আসে আগুন হয়ে জ্বালিয়ে দিতে পারে সমস্ত নূপুরকে।
না, গল্পের ব্যাপারে কিছু বলবো না। কারণ ট্রেলারেই গল্পের কাঠামো বলে দেওয়া আছে, এরপর আরও কিছু বললে সবই বলা হয়ে যাবে। যাকগে, বেশ কিছুদিন ধরে কোয়ালিটি হিন্দি কন্টেন্ট দিতে ব্যর্থ নেটফ্লিক্স এবার ‘হরর’ জনরা এর সাহায্যে বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করেছে। আর সেই চেষ্টায় পুরোপুরি সফল না হলেও চেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। অনুষ্কা শর্মার প্রযোজনায় অনভিতা দত্তের পরিচালনায় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বুলবুল টিপিক্যাল ভারতীয় ‘হরর’ জনরার ছবিগুলির থেকে যথেষ্ট ভালো।
প্রথম প্রশংসা করতে হয় সিনেমাটোগ্রাফি ও অমিত ত্রিবেদির নেপথ্য সংগীতের।একটা ভুতের ছবি তে যে জিনিস টা সবথেকে জরুরি পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে, সেখানেই এই ছবির ছক্কা। রাতের দৃশ্য গুলোতে লাল রঙের দুর্দান্ত ব্যবহার। যখন ‘ভূত’ এর ‘জন্ম’ হলো, চাঁদ কে লাল করে দেখানো। এইভাবে রং একটা সিনেমার চরিত্র হয়ে যাচ্ছে, ভারতীয় ছবিতে ভাবা কঠিন। আর সেই সঙ্গে অদ্ভুত বিষণ্ন কিন্তু ভয়ঙ্কর মিউজিক স্কোর। অভিনয় যে একটা হরর ফিল্মের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এই ছবি তারই উদাহরণ। ‘লায়লা -মজনু’, তৃপ্তি দিমরি ও অবিনাশ তিওয়ারি কে আবার একসাথে পেলাম। এক্ষেত্রে অবিনাশের স্ক্রিন টাইম তুলনামূলক কম। কিন্তু তৃপ্তি চোখ আর মোহময়ী হাসিতে ফাটিয়ে দিয়েছেন। আর তার সাফল্য পাওলি দামের শক্তিশালী অভিনয়ের পাশাপাশি লড়ে যাওয়া। রাহুল বোস, এমনিতেই ভালো অভিনেতা; কথা কম থাকলেও তার উপস্থিতিই যথেষ্ট মনে হচ্ছিল। আর আছেন পরমব্রত, ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে।
তবে সিনেমাটি যেখানে মারা খেয়ে গেছে, তা হলো এডিটিং এবং স্ক্রিনপ্লে তে। হরর ছবি হওয়া সত্বেও বড্ড ধীরগতির প্রথম ভাগ টা জুড়ে। এই ভাগের এডিটিং আরো ভালো হলে রোমাঞ্চের ব্যাপার টা জমতো আরো। যেটা জমতে জমতে জমেনি। ক্লাইম্যাক্সের আগেই প্রেডিক্ট করা যাচ্ছিল। হরর থ্রিলারের ক্ষেত্রে যা একদমই মেনে নেয়া যায়না। ক্লাইম্যাক্স এর ‘রেভেলাশন’ অংশ টা আরো সুন্দর ভাবে, থ্রিলিংভাবে তৈরি করা যেত।এই কারণেই একটা ভালো স্টোরি থাকা সত্ত্বেও ছবিটি ‘এভারেজ’ হয়ে গেছে।
তবে একজনকে প্রশংসা না করলেই নয়। অনুষ্কা শর্মা। তিনি বাকী ফেমিনিস্ট কলিগ দের মতো সারাক্ষন সোস্যাল মিডিয়া বা পাবলিক প্লেসে নারীবাদের ঝাণ্ডা উড়িয়ে বেড়ান মত। তিনি তাঁর মত তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এন এইচ10, পরি, ফিলৌউরি, একের পর এক এক্সপেরিমেন্টাল, সমাজিক ছবি আমাদের উপহার দিচ্ছেন তিনি। তার সাথে সুযোগ করে দিচ্ছেন নতুন নতুন পরিচালকদের। আশা করব তাঁর হাউস থেকে ভবিষ্যতে আরো এক্সপেরিমেন্টাল, সাহসী এবং আরো ভালো ভালো ছবি পেতে থাকবো।
সবশেষে আসব যে ব্যাপারে, তা বাঙালি না হলে রিলেট করতে পারা মুশকিল। এমনিতেই উত্তর ভারত থেকে অনেকদিন পর বলিউডের চিত্রপট বাঙলায় ফিরে এলো। সেইসঙ্গে অনেককিছু বাঙালি সাহিত্য রেফারেন্স। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ চোখের বালি’র মহেন্দ্র-বিনোদিনী, কিংবা নষ্টনীড়ের ‘অমল -চারু’, কস্টিউম ডিজাইনে ‘দেবদাস’ এর ছাপ ইত্যাদি। এভাবেই ভাট দের হরর ছবির নাম করে অত্যাচারের যুগ শেষ হয়ে ভারতীয় হরর ও বিশ্বমানের হবে আশা করি।
রিভিউ
মন্ত্রমুগ্ধ সঙ্গীতের এই বান্দিশ। ওয়েব সিরিজ রিভিউ : বান্ডিশ বান্ডিত্স
বিপাশা দাস : পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম জীব হলো গিয়ে মানব। শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকার গুণের ও অংশীদার তারা। সঙ্গীত যার মধ্যে একটি, লক্ষ্য করে দেখবেন নিত্যদিনের প্রত্যেকটি কর্মের মধ্যে আপনি সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন খুঁজে পাবেন। এই আশ্চর্য মেলবন্ধন কে কাজে লাগিয়ে পরিচালক অঙ্কিত তিওয়ারি বান্ডিশ বান্ডিত্স নামক একটি ওয়েব সিরিজ আমাজন প্রাইম এরপর্দায় নিয়ে এলেন।
গুরুর প্রতি শিষ্যের অপার ভক্তি, সঙ্গীতের প্রতি অনবদ্য প্রেম একজন নিষ্ঠাবান শিষ্যের পরিচয়। পুরাকালের কাহিনী তো সবার কাছে জ্ঞাত, গুরুদেব দ্রোণাচার্য একলব্য এর আঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিবেসে চেয়ে গুরুভক্তির নিদর্শন স্বরূপ অক্ষত রাখেন। তেমনি এই ছবিতে রাধে তার টাকুরদা পণ্ডিত রাধেমোহনকে নিজের গুরুভক্তি এবং প্রেমের নিদর্শন কঠোর পরিশ্রমের সাথে দিয়েছে।
এবার যদি সঙ্গীতের ব্যাখ্যা চান তাহলে বলবো যথাযথ তার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ইতিহাসের দিকে নজর দিলে বুঝতে পারবেন সঙ্গীতের মহিমা কতটা ব্যাপ্ত। আকবরের নবরত্ন অলংকৃত তানসেন নিজের সঙ্গীতেরদ্বারা বৃষ্টি নামাতে পারতেন, ক্ষিপ্ত হাতিকে শান্ত করার ক্ষমতা ও তার গানের দ্বারা ফুটে ওঠে। তবে এই ওয়েব সিরিজের শেষে এমনটাই পরিচয় পেয়ে থাকবেন। ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল গানের সঙ্গেপপ মিউজিক এর অসাধারণ যুগলবন্দি সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। সাথে রাজস্থানের সাংস্কৃতিক প্রতিপত্তি,রাজার উপস্থিতি সবকিছুই যেনো ইতিহাসকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট। আমাদের ভারতবর্ষে ফোক গানের কদর এক আলাদা স্তরেই বিদ্যমান, এত সুন্দর ভাবে তার পরিবেশন সাথে বিভিন্ন অসাধারণ কিছু রাগের উপস্থিতি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের প্রেমে পড়ার জন্য যথেষ্ট।
অতুল কুলকর্ণী, নাসিরউদ্দিন সাহ, তৃধা চৌধুরী, শিবা চড্ডা দের মত নামকরা কিছু তারকাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সবার তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয় এর পরিচয় আমরা আগেও পেয়েছি এই ওয়েব সিরিজেওবেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কিন্তু ঋত্বিক ভৌমিক (রাধে) এবং শ্রেয়া চৌধুরী (তামান্না) র অসাধারণ অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। লিড রোল রাধের পুরো ওয়েব সিরিজ টিকে এক আলাদা জায়গায় স্থান দিয়েছে সাথে তার বন্ধু কবীরের কিছু হাস্যকর মুহূর্তও এবং অটুট বন্ধুত্বের সাক্ষী এই সিরিজটি।
ডিরেকশনে র কথা বললে রাজেস্থানের যোধপুর নামক এই শহরটির সৌন্দর্য্য কে নব বধূর সাজের সাথে মিলিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে যা এককথায় অতুলনীয়। কিন্তু কোথাও গিয়ে কিছু খামতি চোখে ধরা পড়েই। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রকাশ থাকলেও অত্যধিক পরিমাণে অকথ্য ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যার ফলে পরিবারের সঙ্গে বসে দেখার কোনো সুযোগই নেই। সিরিজটির শেষের দিকে পপ এবং ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের ছোয়া তো দূর নায়িকার উপস্থিতিই সরিয়ে দেওয়া হয়। লেখার ক্ষেত্রে এসব খামতি এড়িয়ে যাওয়া দায়।
শ্রীরাম গণপথী র চলচ্চিত্রশিল্প সত্যিই খুবই সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এডিটিং এ লিড রোল রাধে র মাস্কড ম্যান এর থিওরী এবং তার উপস্থাপনা কে দুর্বল ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে মনমাতানো গানের যুগলবন্দী টি সত্যিই অবিস্মরণীয়। সেটা যদি নাই দেখলেন তাহলে কি দেখলেন প্রশ্ন করতে হয়। সঙ্গীত জগতের তিন অনবদ্য সৃষ্টিকর্তা কর্তা সংকর মহাদেভান, এহসান এবং লয়ের হাত ধরেই এই সিরিজের যে উত্থান। তাদের গাওয়া প্রত্যেকটি রাগের মধ্যে যে আলাদাই আবেগ, অনুভূতি,বেদনা,বিরহ,প্রেমের স্পর্ধা প্রকাশ পেয়েছে যা সত্যিই না শুনে বোঝা সাধ্যের বাইরে।