রুকস্যাক
পায়ে পায়ে পাইনের পাকদন্ডীতে।
দেবস্মিতা ঘোষ : বিকেল তখন ৪ টে। একরাশ বিষাদের ভারে ক্লান্ত গাড়ির চাকা গড়গড়িয়ে নেমে চলেছে নিচের দিকে। আর পাহাড়ের উপর থেকে ভেসে আসছে বনপাহাড়ের গান। ডানদিকের আকাশে ফিরতি পথের সূর্য পাহাড়ের মাথায় গা এলিয়ে দিয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় গোধূলিবেলায় এক শায়িত রমণীর লাস্য স্পর্শ করেছে সূর্যের কেশর রঙের আলো। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলির কোনোটিতে তার কটিদেশ আবার কোনোটিতে তার গ্রীবা। দিনান্তে প্রকৃতির প্রেমময় মিলনের সে এক মনোহর দৃশ্য। হঠাৎ গাড়ির হর্নে সম্বিত ফিরতেই বুকের ভেতরটা ডুকরে কেঁদে উঠল। গাড়ি এগিয়ে চলেছে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের দিকে। অতএব বাড়ি ফেরার পালা। পাহাড় গুলো ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ। পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে গাছের শরীর। ঝুপ করে গাড়ির কাছে সন্ধ্যে নেমে এল। পাহাড়ের অন্ধকার আগেও দেখেছি অনেক তবে সেদিন সন্ধ্যার গায়ে লেগেছিল পাহাড়ের সাথে বিরহে চুপচুপে কালো বিষাদের রঙ।
সময়টা ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি। ঠিক দিন চারেক আগে পাহাড়ি শীত উপভোগের লোভটা সামলাতে না পেরে রুকস্যাক গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা দুই বন্ধু। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পা দেওয়া মাত্রই মালুম পেলাম যে আমাদের মত শহুরে শীতবিলাসীদের কাছে এই ঠান্ডা বেশ জাঁকালো হতে চলেছে। সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। টিকালো নাকওয়ালা ছিপছিপে চেহারার একজন এসে বললে,‘নমস্তে ম্যাডাম, লেপচাজগৎ জানা হেনা আপকো?’ বুঝলাম প্ল্যানমাফিক হোমস্টে থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্যাস, এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে রওনা দিলাম লেপচাজগতের উদ্দেশ্যে।
গাড়ি ছুটে চলল রোহিনীর ঝলমলে রাস্তা দিয়ে, শুকনার শালবন পেরিয়ে ঘুম স্টেশনের দিকে। পথে ধোঁয়া ওঠা মোমো আর থুকপায় ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম আমরা। ঘুম থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়েই শুরু হল পাইনের পাকদণ্ডী। বাঁদিকে খাদের কোলে মেঘ আর রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা। কোথাও চোখে পড়ে, ডানামেলা মেঘেদের শরীর পাহাড়ের গায়ে ঘন সবুজ মনখারাপের ছোপগুলোকে আড়াল করে রেখেছে। আবার কোথাও ঘন পাইন বনের মাথায় সূর্য সোনা রঙ যেন বেনী করা খুদে চোখে ছোট্ট মেয়ের চ্যাপ্টার ঠোঁটের হাসি। কথায় কথায় ড্রাইভার দাদার সাথে বেশ আলাপ জমে গেল। পাহাড়ের মানুষ অনেক বেশি সহজ, শহরের মার-প্যাঁচের রকমফের থেকে ওরা সহস্র যোজন দূরে। লেপচাজগৎ প্রাই ৬৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত পাইন বনে ঘেরা, ছোট্ট একটি গ্রাম। পর্যটন এখনও ঠিকমতো প্রবেশ করেনি ওখানে। তাই লেপচাজগৎ আমাদের মত ছিমছাম, নিরালাপ্রিয়, পাহাড়বিলাসীদের কাছে প্রাণের আরামের এক নির্ঝঞ্ঝাট আশ্রয়। বাঁ দিকে গভীর খাদ এবং ডান দিকে ঘন পাইনের জঙ্গলের মাঝে পাকদন্ডীতে নাকি চিতাবাঘও নেমে আসতে দেখা যায়। (ক্রমশ)
রুকস্যাক
ভ্রমণ : বাগুরানের বেলাভূমিতে।
দেবস্মিতা ঘোষ : বাতাসে শীতের আমেজ, সোনালী রোদের অকৃত্রিম স্নেহে আগলে নেওয়া স্বভাব, সুনীল আকাশ সবে মিলে প্রকৃতি যেন কোল পেতে বসে দুবাহু বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আর আপনিও বুঝি নাগরিক ঘোড়দৌড়ে বিধ্বস্ত ????
বেশি নয়, ব্যস্ততার চোখরাঙানি থেকে এক কি দুই দিনের ছুটি বন্দোবস্ত করতে পারলেই মিলবে মুক্তির আস্বাদ। দিগন্তজোড়া নীলের মেলবন্ধন, চোখের পাতায় নেমে আসা বালির চড়, গর্জনরত সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝে একান্তে অবসার কাটাতে পৌঁছে যান পূর্ব মেদিনীপুরের বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্র তটে।
কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে বা হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন এ কাঁথি পৌঁছে যান। কাঁথি থেকে টোটোতে ২৫০-৩০০ টাকার বিনিময়ে প্রায়ে ২৪ কিমি পথ অতিক্রম করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্রতীরে। সমুদ্র এখানে শান্ত।
আর একটি অভিনব বিষয় হল জোয়ারের সময় সমুদ্র তীরের অনেক কাছে চলে আসে আবার ভাটার সময় অনেক দূরে চলে যায়। সারা তত জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় লাল কাঁকড়ার অবাধে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলা। সমুদ্রে সূর্যোদয় সাক্ষী থাকা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাই হাতে ছুটি একদিন বেশি থাকলে একদিন থেকে যাওয়ায় ভালো।
দিঘা, মান্ডারমনি বা জুনপুটের মতো পর্যটন এর ঘেরাটোপ বগুরান কে গ্রাস করেনি এখনো। তাই অফবিট এ নিরিবিলি ছুটি কাটানোর সেরা ঠিকানা হল বগুরান। জুনুপুট সমুদ্রতীর, দরিয়াপুর, কপালকুণ্ডলা মন্দির কাছাকাছির মধ্যেই ঘুরে দেখে নেয়া যায়। এখান থেকে আপনি আশে পাশের সমুদ্রসৈকত গুলিও ঘুরে আসতে পারেন যেমন বাঁকিপুট, দিঘা, মান্ডারমনি, তাজপুর।
তবে এখানে রাত্রিবাসের একমাত্র ঠিকানা হলো হোটেল সাগর নিরালা। কারণ খুব বেশিদিন হয়নি বগুরান বাংলার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। শহুরে জীবন যেসমস্ত সুবিধায় অভ্যস্ত সেই সব রকম সুবিধা এবং তিনবেলার আহার নিয়ে রাত্রিবাসের খরচ মোটামুটি কমবেশি ১০০০ টাকা।
এই শীতে তবে উইকেন্ডে প্ল্যান করেই ফেলুন বগুরান জলপাই সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে বালিতে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে কেটে, কিংবা লাল কাঁকড়ার দল কে গর্ত অবধি ধাওয়া করে, কিংবা আবার ভোরের আধো আলোয় প্রিয়জনের সাথে ঝিনুক কুড়িয়ে দারুন কাটবে ছুটির দিনগুলো।