রুকস্যাক
পায়ে পায়ে পাইনের পাকদন্ডীতে..। (২)
দেবস্মিতা ঘোষ : বাঁদিকে গভীর খাদ এবং ডান দিকে ঘন জঙ্গলের মাঝে পাকদন্ডীতে নাকি চিতাবাঘও নেমে আসতে দেখা যায় শুনেছি। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে খানিক। ধীরে ধীরে একটা সাদা কুয়াশার ভেতরে ঢুকে পড়ল গাড়ি। কাঁচ ভেদ করে একটা কনকনে ঠান্ডা এসে হাতে, ঘাড়ে চেপে বসল। এই ঠান্ডায় নিজেকে সইয়ে নেওয়ার আগেই ড্রাইভার দাদা বলল,“আগয়া হ্যায় সাব, চলিয়ে…।” তাকিয়ে দেখি বাঁদিকে খাদের ধারে ছোট্ট ঝকঝকে বাড়ি।
নাম গ্রিন ভ্যালি হোম স্টে। রংবেরঙের পাহাড়ি ফুল গাছে সাজানো বারান্দা দিয়ে প্রবেশ করে বাইরের দিকে দুটো কাঠের ঘর। জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই চোখে পড়ল পাহাড়ের ঢালে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন গাছের সংসার আর দূরের ধূসর রঙের পাহাড়গুলি। অনেকটা তুলি-রঙে এ আঁকা জলছবির মত। বিশ্বের বিপুল কর্মযজ্ঞ এখানে যেন স্থবির হয়ে আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। চোখের পাতায় জুড়িয়ে রইলো প্রকৃতির এক অপরূপ জাদুকরী। চারপাশে এখানে এতটাই প্রশান্তি এবং মৌনতা বিরাজ করে যেন পাইনের মাথায় ক্রমাগত মেঘেদের পদচারণার শব্দ শোনা যায়। হঠাৎ কি জানি এক স্বর্গসুখে আমরা যখন বিভোর হয়ে আছি বছর কুড়ির একটি ছেলে এসে খবর দিল লাঞ্চ রেডি। পেটের খিদেও তখন তুঙ্গে।
কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে হোমস্টের ডাইনিংয়ে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, সবজি ডাল, ভাজি, ডিমের ডালনায় স্বর্গরাজ্যে বসে অমৃতপানের সুখ পাওয়া গেল। একটুখানি জিরিয়ে নিতে গিয়ে কখন সন্ধ্যে নেমে গেছে টেরই পেলাম না। পাহাড়ে সাধারণত সন্ধে নামার পর আর তেমন কিছু করার থাকেনা। তবে বলাই বাহুল্য, লেপচাজগৎ এর সন্ধ্যেতে চোখের বিরাম মিলল না। গরম পোশাকে নিজেদের মুড়িয়েনিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম হোমস্টের ছাদে। দার্জিলিং থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরের এই গ্রামটির দু-একটা হোমস্টের আলো ছাড়া পুরোটাই অন্ধকার।আদিগন্ত গাঢ় নীল রঙের আকাশের নিচে আমরা অন্ধকারের গালচে পেতে বসলাম। সঙ্গে রইল প্লেটপুরে গরম ফুলকপির পাকোড়া। পাইনের জঙ্গলে চাঁদের আলো পড়ে যে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দৃশ্যগোচর হল তা ভোলার নয়। ক্রমাগত তাকে সঙ্গত করে চলল একটানা ঝিঁঝির ডাক। কপাল নেহাত মন্দ ছিল না, তাই সন্ধ্যের মেঘহীন আকাশে জোনাকির মতো অগুন্তি উজ্জল তারাদের আলোর খেলা দেখতে দেখতে কেটে গেল সন্ধ্যেটা। পরিকল্পনা অনুযায়ী পরেরদিন আমার মতো শহুরে শীতকাতুরেদের কাকভোরে ঘুম থেকে ওঠার পালা। খানিক কষ্টসাধ্য হলেও উদ্দীপনা চরমে। তখন কেবল হাতছানি দিচ্ছে ভোরের পাহাড়, দার্জিলিং চা আর গন্তব্যতাকদাহ্-তিনচুলে। (ক্রমশ)
রুকস্যাক
ভ্রমণ : বাগুরানের বেলাভূমিতে।
দেবস্মিতা ঘোষ : বাতাসে শীতের আমেজ, সোনালী রোদের অকৃত্রিম স্নেহে আগলে নেওয়া স্বভাব, সুনীল আকাশ সবে মিলে প্রকৃতি যেন কোল পেতে বসে দুবাহু বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আর আপনিও বুঝি নাগরিক ঘোড়দৌড়ে বিধ্বস্ত ????
বেশি নয়, ব্যস্ততার চোখরাঙানি থেকে এক কি দুই দিনের ছুটি বন্দোবস্ত করতে পারলেই মিলবে মুক্তির আস্বাদ। দিগন্তজোড়া নীলের মেলবন্ধন, চোখের পাতায় নেমে আসা বালির চড়, গর্জনরত সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝে একান্তে অবসার কাটাতে পৌঁছে যান পূর্ব মেদিনীপুরের বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্র তটে।
কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে বা হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন এ কাঁথি পৌঁছে যান। কাঁথি থেকে টোটোতে ২৫০-৩০০ টাকার বিনিময়ে প্রায়ে ২৪ কিমি পথ অতিক্রম করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্রতীরে। সমুদ্র এখানে শান্ত।
আর একটি অভিনব বিষয় হল জোয়ারের সময় সমুদ্র তীরের অনেক কাছে চলে আসে আবার ভাটার সময় অনেক দূরে চলে যায়। সারা তত জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় লাল কাঁকড়ার অবাধে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলা। সমুদ্রে সূর্যোদয় সাক্ষী থাকা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাই হাতে ছুটি একদিন বেশি থাকলে একদিন থেকে যাওয়ায় ভালো।
দিঘা, মান্ডারমনি বা জুনপুটের মতো পর্যটন এর ঘেরাটোপ বগুরান কে গ্রাস করেনি এখনো। তাই অফবিট এ নিরিবিলি ছুটি কাটানোর সেরা ঠিকানা হল বগুরান। জুনুপুট সমুদ্রতীর, দরিয়াপুর, কপালকুণ্ডলা মন্দির কাছাকাছির মধ্যেই ঘুরে দেখে নেয়া যায়। এখান থেকে আপনি আশে পাশের সমুদ্রসৈকত গুলিও ঘুরে আসতে পারেন যেমন বাঁকিপুট, দিঘা, মান্ডারমনি, তাজপুর।
তবে এখানে রাত্রিবাসের একমাত্র ঠিকানা হলো হোটেল সাগর নিরালা। কারণ খুব বেশিদিন হয়নি বগুরান বাংলার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। শহুরে জীবন যেসমস্ত সুবিধায় অভ্যস্ত সেই সব রকম সুবিধা এবং তিনবেলার আহার নিয়ে রাত্রিবাসের খরচ মোটামুটি কমবেশি ১০০০ টাকা।
এই শীতে তবে উইকেন্ডে প্ল্যান করেই ফেলুন বগুরান জলপাই সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে বালিতে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে কেটে, কিংবা লাল কাঁকড়ার দল কে গর্ত অবধি ধাওয়া করে, কিংবা আবার ভোরের আধো আলোয় প্রিয়জনের সাথে ঝিনুক কুড়িয়ে দারুন কাটবে ছুটির দিনগুলো।