রিভিউ
“কি হবে ভালোবেসে?” মুভি রিভিউ: গুলাবো সিতাবো
সৌমেন্দু বাগ : করোনা আতঙ্ক, সচেতনতা ইত্যাদি বাধার জন্য বলিউডও পা বাড়াচ্ছে নতুন যুগের দিকে, সুজিত সরকারের ছবি‘গুলাবো সিতাবো’ মুক্তি পেয়ে গেল আমাজন প্রাইম মিডিয়াতে। বহুদিন আগে বচ্চনজি এবং আয়ুষ্মানের একটি ফটো প্রকাশ হওয়া থেকেই চর্চা শুরু হয় আর আজ তা যে যখন দুঘন্টার পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি হিসেবে সামনে এলো, একটা কথাই প্রযোজ্য, সুজিত বাবুর প্রত্যাবর্তন।গুলাবো, সিতাবো। পুতুলনাচের দুই চরিত্র, যারা শুধু লড়ে যায়, তাদের নিয়তি বাঁধা কোনো অদৃশ্য সুতো দিয়ে, লড়াই শেষে পায় না কিচ্ছুটি, তাকিয়ে থাকে দিগন্তের দিকে, কালকের অপেক্ষায়।
মির্জা এবং বাঁকের গল্পটা শুরু হয় এমনই পুতুলনাচের করুণ রসিকতার রেফারেন্সটুকু সঙ্গে নিয়ে৷ আটাত্তর বছরের বুড়ো মির্জা আগলে বসে থাকে তার বেগমজানের পৈতৃক ভিটে, সাধের ‘ফতিমা মহল’। বহু ব্যবহারে জীর্ণ, ভেঙেচুরে যাওয়া সেই প্রাসাদের কয়েকটি ঘর ভাড়াটেদের একজন হল বাঁকে৷ মির্জার ক্ষয়িষ্ণু জীবনের একমাত্র অবশিষ্ট ইচ্ছে, লোভ, মনোবাসনা হল এই গোটা প্রাসাদটা একদিন তার নামে হয়ে যাবে৷ তাই সে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে থাকে তার থেকে সতেরো বছরের বড় বেগমজানের এন্তেকাল কবে হবে – সেই শুভক্ষণের।
অন্যদিকে বাঁকের লক্ষ্য হল মাসিক তিরিশ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে যতদিন সম্ভব এই প্রাসাদেই থেকে যাওয়া৷ তার জীবনে অর্থাভাব আছে, কাঁধের ওপর রয়েছে তিন তিনজন বোনের দায়িত্ব আর মনের এককোণায় আছে ফৌজিয়া নামের একটি মেয়ের প্রতি প্রেম৷ সেই প্রেমের যাবতীয় সুসম্ভাবনা অজস্র দায়ভার এবং অশেষ দারিদ্রের ঠেলায় ক্রমশ বিলীয়মান।’লোভ বড় খারাপ জিনিস। একবার সে যদি বেতালের মতো তোমার ঘাড়ে বসতে পারে, তার ভার বইতে বইতে তুমি কুঁজো হয়ে পড়বে।’ জীবনের এইটুক একটা সত্যি কথাকে ঘিরে সুজিত বাবু এক খানা ছবি বানিয়ে ফেললেন, ভাবা যায়!
মির্জা ও বাঁকের দ্বন্দ্ব এই ফতিমা মহলকে কেন্দ্র করেই৷ তারা তাদের সীমিত বুদ্ধিতে ভর করে নিরন্তরভাবে ছলচাতুরী চালিয়ে যায় নিজের নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য৷ গল্পের প্রয়োজনেই হয়তো তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ধূর্ত উকিল ক্রিস্টোফার ক্লার্ক এবং প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কৌশলী অফিসার জ্ঞানেশ শুক্লা৷ এরপর যা শুরু হয়, তা এক বিচিত্র ‘Cat and mouse’ খেলা। যে খেলায় প্রত্যেকেই জয়ী হতে চায়, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারে না কেউই। শেষ অবধি এদের পরিণতি কী হয়? কোন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা তাদের নিয়তি।
ছবিটির সম্পদ হল অভিনয়৷ সহজাত সমস্ত ম্যানারিজম ও ব্যারিটোন ভয়েসকে মুছে ফেলে, স্টার স্টেটমেন্ট ভেঙে ফেলে মির্জার চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন যে অভিনয়টা করেছেন সেটা হয়ত তাঁর কেরিয়ারের অন্যতম মাইলফলক হয়ে থাকবে৷ বাঁকের চরিত্রে আয়ুষ্মানও ঠিক ততটাই ভালো৷ অমিতাভর ছায়ায় এতটুকুও ঢাকা পড়ে না গিয়ে, গোটা ছবি জুড়ে তিনি নিজের মতো উজ্জ্বল, নিজের মতোই মলিন৷ আর যেহেতু সুজিতের সাথে দুজনেরই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তাই তাঁদের মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ অভিনয় টুকু ছেঁকে বের করার আনতে পেড়েছেন। আর সুজিত সরকার এর ছবি বা জুহি চতুর্বেদির চিত্রনাট্য… ‘ পার্শ্বচরিত্র’ একটা বড় ভূমিকা পালন করে থাকবেই। এক্ষেতেও তাই বিজয় রাজ, বিজেন্দ্র কালা এবং সর্বোপরি ফারুখ জফর… প্রত্যেকেই৷ ফারুখ জাফর এর স্ক্রিন টাইম এবং ডয়ালগ কম হলেও নজর কেড়ে নেন। আর এখানেই একজন অভিনেতার সার্থকতা, এত স্টারদের ভিড়ে নিজের পরিচয় টুকু প্রকাশ করা।আর বলতে হয় সৃষ্টি শ্রীবাস্তব অভিনীত গুড্ডো চরিত্রটির কথা৷ অদ্ভুত একটি edgy অথচ আত্মবিশ্বাসী চরিত্রে সৃষ্টির অভিনয় মনে থেকে যায়৷ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে ‘ ফাতিমা মহল’ এবং লখনৌ শহর। ঠিক যেমন ‘মাদ্রাস ক্যাফে’ তে ওই চার্চ, পিকুতে গাড়ীটি আর হাইওয়ে , অক্টোবরে শিউলি ফুল, তেমনই এই ছবির কথা মনে এলে এই মহলের কথা মনে পড়তে বাধ্য। পুতুলনাচের লড়াইয়ে এ যেন সেই ‘বাসনা’ যাকে পাওয়ার জন্য খুচরো জমাতে থাকে মাদারি।
ইতিহাসবর্জিত লখনৌ শহর। নিজের সবটুকু প্রাচীনতা ও আভিজাত্য নিয়ে ভারী বিষণ্ণসুন্দররূপে এক ক্যানভাসের কাজ করেছে এই শিল্পের সৃষ্টিতে। এজন্য অভীক মুখোপাধ্যায় এর প্রশংসা প্রাপ্য।
মূলত লোকগাননির্ভর সুর ছবিটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে৷ গানের জন্য আলাদা সময় দেওয়া হয়নি। আমাদের চিরবহমান , অক্লান্ত জীবনের মাঝে গান যেমন ঠিক খুঁজে নেয় তার স্থান, তেমন রাহুল রামের কণ্ঠে ‘দো দিন কা ইয়ে মেলা হ্যায়’ বা বিনোদ দুবের ‘ক্যায় লেকে আয়ো জ্যগমে’-র মতো গান গল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায় অত্যন্ত অনায়াসেই৷ জুহি চতুর্বেদীর স্ক্রিপ্ট। না, এনার লেখা আলাদা করে নজর কাড়বে না আপনার। কারণ সিনেমা আর জীবনের মাঝের যে দেয়ালটুকু থাকে, সেটাকে উনি ভেঙে ফেলেন তার সহজ, সূক্ষ্ম, স্বমহিম কলমের আঁচড়ে। তাঁর চরিত্র রা কেও অসাধারণ হতে চায় না, তারা বেঁচে থাকে, আমাদেরই মত, ভুল ভ্রান্তি, আশা , নিরাশা, ভালোবাসা, বিরক্তি সব কিছু নিয়ে। তবে এই ছবির প্রসঙ্গে বলতে হয় প্রথম এক ঘন্টা আরেকটু নির্মেদ হতেই পারত৷ অনেক যারা একটু দ্রুত গতির ছবি দেখতে পছন্দ করেন, তারা আপত্তি জানাতে পারেন। সেক্ষেত্রে ছবির এডিটিং ও কিছু জায়গায় বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু অন্তিম এক ঘন্টা সিনেমার ভাষায় বললে ‘ পয়সা ওয়াসুল’।
এই গল্প পুরোনো শহরের অলিতে গলিতে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়৷ ছোট ছোট মানুষের জীবনের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ-আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ভালোবাসার কথা শোনায়৷ সেই ভালোবাসা অন্য কোনও মানুষের প্রতিই হোক অথবা ইট-কাঠ-পাথরের তৈরি কোনও প্রাচীন অট্টালিকার প্রতি৷ অনেক কিছু চেয়েও যারা কিছুই পায় না শেষ অবধি, তাদের জন্য কোথা থেকে যেন ভেসে আসে সুর…”দো দিন কা ইয়ে মেলা হে,খেলা ফির উঠ জানা হে। আররে দো দিন কা ইয়ে মেলা হে।”
আর এসব থেকে খানিকটা দূরে, অখ্যাত এক পুতুলনাচের আসরে বৃথাই বিবাদ করে মরে দু’টি পুতুল৷ তাদের নাম – গুলাবো আর সিতাবো৷ পায় না কিচ্ছুটি, তবুও তারা লড়ে যায় প্রতিদিন৷ তারপর কখন যে কোন অদৃশ্য থেকে সুতোয় টান পড়ে, খেলা গুটিয়ে নিয়ে ফিরে যায় ক্লান্ত বাজিকর৷ তখন শুধুই পড়ে থাকে ফুরিয়ে আসা একটা দিনের বিষণ্ণ, মলিন আলো…
রিভিউ
মন্ত্রমুগ্ধ সঙ্গীতের এই বান্দিশ। ওয়েব সিরিজ রিভিউ : বান্ডিশ বান্ডিত্স
বিপাশা দাস : পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম জীব হলো গিয়ে মানব। শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকার গুণের ও অংশীদার তারা। সঙ্গীত যার মধ্যে একটি, লক্ষ্য করে দেখবেন নিত্যদিনের প্রত্যেকটি কর্মের মধ্যে আপনি সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন খুঁজে পাবেন। এই আশ্চর্য মেলবন্ধন কে কাজে লাগিয়ে পরিচালক অঙ্কিত তিওয়ারি বান্ডিশ বান্ডিত্স নামক একটি ওয়েব সিরিজ আমাজন প্রাইম এরপর্দায় নিয়ে এলেন।
গুরুর প্রতি শিষ্যের অপার ভক্তি, সঙ্গীতের প্রতি অনবদ্য প্রেম একজন নিষ্ঠাবান শিষ্যের পরিচয়। পুরাকালের কাহিনী তো সবার কাছে জ্ঞাত, গুরুদেব দ্রোণাচার্য একলব্য এর আঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিবেসে চেয়ে গুরুভক্তির নিদর্শন স্বরূপ অক্ষত রাখেন। তেমনি এই ছবিতে রাধে তার টাকুরদা পণ্ডিত রাধেমোহনকে নিজের গুরুভক্তি এবং প্রেমের নিদর্শন কঠোর পরিশ্রমের সাথে দিয়েছে।
এবার যদি সঙ্গীতের ব্যাখ্যা চান তাহলে বলবো যথাযথ তার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ইতিহাসের দিকে নজর দিলে বুঝতে পারবেন সঙ্গীতের মহিমা কতটা ব্যাপ্ত। আকবরের নবরত্ন অলংকৃত তানসেন নিজের সঙ্গীতেরদ্বারা বৃষ্টি নামাতে পারতেন, ক্ষিপ্ত হাতিকে শান্ত করার ক্ষমতা ও তার গানের দ্বারা ফুটে ওঠে। তবে এই ওয়েব সিরিজের শেষে এমনটাই পরিচয় পেয়ে থাকবেন। ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল গানের সঙ্গেপপ মিউজিক এর অসাধারণ যুগলবন্দি সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। সাথে রাজস্থানের সাংস্কৃতিক প্রতিপত্তি,রাজার উপস্থিতি সবকিছুই যেনো ইতিহাসকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট। আমাদের ভারতবর্ষে ফোক গানের কদর এক আলাদা স্তরেই বিদ্যমান, এত সুন্দর ভাবে তার পরিবেশন সাথে বিভিন্ন অসাধারণ কিছু রাগের উপস্থিতি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের প্রেমে পড়ার জন্য যথেষ্ট।
অতুল কুলকর্ণী, নাসিরউদ্দিন সাহ, তৃধা চৌধুরী, শিবা চড্ডা দের মত নামকরা কিছু তারকাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সবার তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয় এর পরিচয় আমরা আগেও পেয়েছি এই ওয়েব সিরিজেওবেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কিন্তু ঋত্বিক ভৌমিক (রাধে) এবং শ্রেয়া চৌধুরী (তামান্না) র অসাধারণ অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। লিড রোল রাধের পুরো ওয়েব সিরিজ টিকে এক আলাদা জায়গায় স্থান দিয়েছে সাথে তার বন্ধু কবীরের কিছু হাস্যকর মুহূর্তও এবং অটুট বন্ধুত্বের সাক্ষী এই সিরিজটি।
ডিরেকশনে র কথা বললে রাজেস্থানের যোধপুর নামক এই শহরটির সৌন্দর্য্য কে নব বধূর সাজের সাথে মিলিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে যা এককথায় অতুলনীয়। কিন্তু কোথাও গিয়ে কিছু খামতি চোখে ধরা পড়েই। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রকাশ থাকলেও অত্যধিক পরিমাণে অকথ্য ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যার ফলে পরিবারের সঙ্গে বসে দেখার কোনো সুযোগই নেই। সিরিজটির শেষের দিকে পপ এবং ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের ছোয়া তো দূর নায়িকার উপস্থিতিই সরিয়ে দেওয়া হয়। লেখার ক্ষেত্রে এসব খামতি এড়িয়ে যাওয়া দায়।
শ্রীরাম গণপথী র চলচ্চিত্রশিল্প সত্যিই খুবই সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এডিটিং এ লিড রোল রাধে র মাস্কড ম্যান এর থিওরী এবং তার উপস্থাপনা কে দুর্বল ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে মনমাতানো গানের যুগলবন্দী টি সত্যিই অবিস্মরণীয়। সেটা যদি নাই দেখলেন তাহলে কি দেখলেন প্রশ্ন করতে হয়। সঙ্গীত জগতের তিন অনবদ্য সৃষ্টিকর্তা কর্তা সংকর মহাদেভান, এহসান এবং লয়ের হাত ধরেই এই সিরিজের যে উত্থান। তাদের গাওয়া প্রত্যেকটি রাগের মধ্যে যে আলাদাই আবেগ, অনুভূতি,বেদনা,বিরহ,প্রেমের স্পর্ধা প্রকাশ পেয়েছে যা সত্যিই না শুনে বোঝা সাধ্যের বাইরে।