রুকস্যাক
পায়ে পায়ে পাইনের পাকদন্ডীতে..। (৩)
দেবস্মিতা ঘোষ : তখন কেবল হাতছানি দিচ্ছে ভোরের পাহাড়, দার্জিলিং চা আর গন্তব্য তাকদাহ্-তিনচুলে। পাহাড়ের একটা নিজস্ব শৃঙ্খলতা আছে। পাহাড়ে পা রাখা মাত্রই নগরজীবনের বিশৃঙ্খলতাকে ঝেড়ে ফেলে সব মানুষইকেমন পাহাড়ি জীবনের সাবলীলতায় নিজেকে বেঁধে ফেলে। কথামতো কাঁটায় কাঁটায় ৯ টায় গাড়ি এসে হাজির। আমাদের ঘরের সামনে বারান্দায় যেখানে এক ফালি রোদ এসে পড়ে আর উত্তর থেকে ভেসে আসা হিমেল হাওয়ার পাহাড়ি গন্ধে ম ম করে চারিদিক। ঠিক সেই রোদ্দুরে মোড়া পেতে বসে কিছুক্ষণ আগে আমরা লেপচাজগতে সকাল হতে দেখেছি। সঙ্গে দার্জিলিং-চায়ের চুমুকে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে শরীর-মন। সেইমুহূর্তটায় কোনো পিছুটান ছিল না। ছিল না ঘরে ফেরার কোনো তাগিদ।
মাথার উপর যতটা খোলা আকাশ সবটুকু স্বাধীনতা দিয়ে প্রকৃতি আমাদের আলিঙ্গন করে রেখেছে। তবু স্বীকার করতেই হয়, আমরা বড়ই লোভী। প্রকৃতির আরও কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া না করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের পথে। প্রথম গন্তব্য তাকদাহ্। দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় ২৮ কিমি দূরে অবস্থিত তাকদাহ্ স্বাধীনতার পূর্বে একটি ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট এলাকা হিসেবে গড়ে উঠেছে। লেপচাদের স্থানীয় ভাষায়‘তাকদাহ্’ কথার অর্থ‘কুয়াশা’। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ সর্পিল পথ, পাখিদের হরবোলা, চা বাগানের সবুজ সমারোহকে কুয়াশার চাদরে স্বস্নেহে আগলে রাখে পরমা প্রকৃতি। পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে গাড়ির চাকার দীর্ঘক্ষণগড়গড় শব্দের গোঙানি যাত্রা পথকে রোমাঞ্চকর করে তুললেও দুজনেরই কানে ভোঁ লেগে খানিক অস্বস্তিতেই পড়তে হল।
গাড়ি এসে থামল তাকদাহ্ অর্কিড সেন্টারের সামনে। এশিয়ার অর্কিড সেন্টার গুলির মধ্যে অন্যতম এই পার্কটি আয়তনে বিশাল। বিভিন্ন প্রজাতির হিমালয়ান অর্কিড এখানে সংরক্ষণ এবং চাষ করা হয়। তাকদাহ্-র জঙ্গল পেরিয়ে রওনা দিলাম তিনচুলের দিকে। তিনটি পর্বতশ্রেণী এই স্থানে এসে মিলিত হয়েছে বলে স্থানীয়দের ভাষায় এই ভিউপয়েন্টের নাম তিনচুলে ভিউপয়েন্ট। ভিউ যা পাওয়া গেল তা নিঃসন্দেহে ভাষায় অবর্ণনীয়। পেডঙের এই উঁচু হিলটপটি থেকে দার্জিলিং এবং সিকিম হিমালয়ের প্রায় পুরো রেঞ্জটির একটি ৩৬০° প্যানোরমিক ভিউ পাওয়া যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ভুটান এবং তিব্বতের কিছু অংশ চোখে পড়ে যা পর্যটকদের কাছে উপরি পাওনা। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন আমরা পেয়েছিলাম রোদঝকমকে সোনালী দিন। নিচে পাহাড় যেন তার শরীরে রঙিন আঁচল বিছিয়ে মোহময়ী রূপ ধারণ করেছে। কোথাও পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে ঘন সবুজ ধানক্ষেত, কোথাও পাইনের জঙ্গল, কোথাও বিনুনির মতো নেমে এসেছে ধসের রেখা। ভিউপয়েন্টেএকজন স্থানীয় নেপালি কে দোকানে মোমো বানাতে দেখে আর লোভ সামলানো গেল না। সেদিন প্রকৃতির ক্যানভাসে বিধাতার রং-তুলির নিপুণ হাতের অনির্বচনীয় শিল্পকর্মের সাক্ষী রইলাম আমরা।(ক্রমশ)
রুকস্যাক
ভ্রমণ : বাগুরানের বেলাভূমিতে।
দেবস্মিতা ঘোষ : বাতাসে শীতের আমেজ, সোনালী রোদের অকৃত্রিম স্নেহে আগলে নেওয়া স্বভাব, সুনীল আকাশ সবে মিলে প্রকৃতি যেন কোল পেতে বসে দুবাহু বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আর আপনিও বুঝি নাগরিক ঘোড়দৌড়ে বিধ্বস্ত ????
বেশি নয়, ব্যস্ততার চোখরাঙানি থেকে এক কি দুই দিনের ছুটি বন্দোবস্ত করতে পারলেই মিলবে মুক্তির আস্বাদ। দিগন্তজোড়া নীলের মেলবন্ধন, চোখের পাতায় নেমে আসা বালির চড়, গর্জনরত সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝে একান্তে অবসার কাটাতে পৌঁছে যান পূর্ব মেদিনীপুরের বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্র তটে।
কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে বা হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন এ কাঁথি পৌঁছে যান। কাঁথি থেকে টোটোতে ২৫০-৩০০ টাকার বিনিময়ে প্রায়ে ২৪ কিমি পথ অতিক্রম করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্রতীরে। সমুদ্র এখানে শান্ত।
আর একটি অভিনব বিষয় হল জোয়ারের সময় সমুদ্র তীরের অনেক কাছে চলে আসে আবার ভাটার সময় অনেক দূরে চলে যায়। সারা তত জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় লাল কাঁকড়ার অবাধে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলা। সমুদ্রে সূর্যোদয় সাক্ষী থাকা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাই হাতে ছুটি একদিন বেশি থাকলে একদিন থেকে যাওয়ায় ভালো।
দিঘা, মান্ডারমনি বা জুনপুটের মতো পর্যটন এর ঘেরাটোপ বগুরান কে গ্রাস করেনি এখনো। তাই অফবিট এ নিরিবিলি ছুটি কাটানোর সেরা ঠিকানা হল বগুরান। জুনুপুট সমুদ্রতীর, দরিয়াপুর, কপালকুণ্ডলা মন্দির কাছাকাছির মধ্যেই ঘুরে দেখে নেয়া যায়। এখান থেকে আপনি আশে পাশের সমুদ্রসৈকত গুলিও ঘুরে আসতে পারেন যেমন বাঁকিপুট, দিঘা, মান্ডারমনি, তাজপুর।
তবে এখানে রাত্রিবাসের একমাত্র ঠিকানা হলো হোটেল সাগর নিরালা। কারণ খুব বেশিদিন হয়নি বগুরান বাংলার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। শহুরে জীবন যেসমস্ত সুবিধায় অভ্যস্ত সেই সব রকম সুবিধা এবং তিনবেলার আহার নিয়ে রাত্রিবাসের খরচ মোটামুটি কমবেশি ১০০০ টাকা।
এই শীতে তবে উইকেন্ডে প্ল্যান করেই ফেলুন বগুরান জলপাই সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে বালিতে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে কেটে, কিংবা লাল কাঁকড়ার দল কে গর্ত অবধি ধাওয়া করে, কিংবা আবার ভোরের আধো আলোয় প্রিয়জনের সাথে ঝিনুক কুড়িয়ে দারুন কাটবে ছুটির দিনগুলো।