রুকস্যাক
পায়ে পায়ে পাইনের পাকদন্ডীতে..। (৪)
দেবস্মিতা ঘোষ – সেদিন প্রকৃতির ক্যানভাসে বিধাতার রং-তুলির নিপুণ হাতের অনির্বচনীয় শিল্পকর্মের সাক্ষী রইলাম আমরা। তারপর ভিউপয়েন্টের নীচ দিয়ে মাটি-পাথরের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা দিয়ে গাড়ি দুলতে দুলতে নেমেচলল। ডানদিকে তাকালেই গভীর খাদ চোখে পড়ে। আবার কখনও গাছেদের মাথা ঝুঁকিয়ে তৈরি করা ছায়াময় সুড়ঙ্গপথ দিয়ে কিছুটা নেমে গিয়ে আবার রোদেলা চড়াই ধরল গাড়ি। এসে পড়ল পাহাড়িয়া জনপদে। সরু রাস্তা,দুপাশে ছোটো ছোটো রঙিন বাড়ি, যেন দেশলাই বাক্স দিয়ে সাজানো। এইভাবে টাইম মেশিনে চড়ে স্বপ্নের দেশে পৌঁছে যাওয়ার মতই আমরাও পোঁছে গেলাম লামাহাট্টা ইকোপার্কে।
এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা পাইনের উদ্যান। বিভিন্ন প্রজাতির রংবেরঙের পাহাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো বাগান পেরিয়ে উপরে উঠলে পাইনের জঙ্গল। দুপাশে পাইনের সারির মধ্যে দিয়ে প্রায় ১ কিমি ট্রেকিং করে চড়াইপথ পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় এক পবিত্র জলাশয়ে। স্থানীয়রা যাকে বলে‘Sacred Pond’। কপাল ভালো থাকলে এখান থেকেই অনেকে অপরদিকে তুষারশৃঙ্গের সাক্ষাৎ পেতে পারেন। মানুষের পরম আদরে প্রকৃতি এই স্থানে আপন উদারতায় বিরাজমান। লামাহাট্টা থেকে বেরোতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। ঠান্ডায় রীতিমতো কাবু হয়ে হোমস্টে তে ফিরে দেখি চা-স্ন্যাক্স রেডি। এই পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য বছর কুড়ির আবেশের হাতের আদুরে ধোঁয়া-ওঠা মোমো আর ডিনারে চিকেন-রুটিতে পাহাড়ের অন্ধকার যাপন আরও জমে উঠল। প্ল্যান হয়ে রইল পরদিন ভোরের অন্ধকরে সকলের অগোচরে আমরা পৌঁছে যাবো কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউপয়েন্টে।
পাহাড়ে পা রাখা মাত্রই কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পাওয়ার জন্য মনটা কেমন বিহ্বল হয়ে থাকে। নির্ভেজাল আরামের মধ্যেও‘সবপেয়েছি’র পরিতৃপ্তি যেন পূর্ণতা পায় না। হোমস্টে থেকে নামলেই রাস্তায় পা পড়ে। আর রাস্তার ফুটছয়েক পেরোলেই পাহাড়ের গা বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে পাইনের জঙ্গল। এলোমেলো পথ, রাস্তা তেমনভাবেনেই বললেই চলে। অতি সন্তর্পনে একরকম ট্রেক করেই পাহাড়ের মাথায় ভিউপয়েন্টে পৌঁছতে হয়। তখন ভোর পৌনে পাঁচটা হবে, টর্চ আর ক্যামেরা নিয়ে যাত্রা শুরু হল। রাস্তা থেকে পাহাড়ের গায়ে প্রথম ধাপটি অর্ধেক মানুষ উঁচু। উপরে তাকাতেই দেখি দুটি চোখ আমাদের দিকে জ্বলজ্বল করছে। চারিদিকে ঘন নীল রঙের অন্ধকার। বুকের ভেতরটা কেমন ঢিপঢিপ করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ স্থির থেকে ঠাহর করাগেল ওটি একটি লোমশ পাহাড়ি কুকুর। মনে খানিক বল পাওয়া গেল। অপ্রত্যাশিতভাবে ওই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে আগে আগে চলল। আমাদেরই পায়ের আওয়াজ বুমেরাং হয়ে কানে এসে বাজছে। আর আছে ঝিঁঝিঁর ডাক।ধীরে ধীরে অন্ধকরের গাঢ় নীল রঙ হালকা হতে থাকল। পাখিদের কিচিরমিচির সঙ্গে নিয়ে উপরে প্রায় মিনিট কুড়ি ওঠার পর হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি বিশাল কাঞ্চনজঙ্ঘা তুষারশৃঙ্গ নিয়ে সশরীরে দাঁড়িয়ে আছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে কোনাকুনি ডানদিকে টাইগার হিল। পেছন থেকে সূর্য ধীরে ধীরে উঠে এসে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে রঙ ঢেলে ঢেলে বিভিন্ন রঙে সাজিয়ে তুলল। ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ৩৬০° ঘুরে তাকালে যেন স্বপ্নপুরীর মত মনে হয়। শায়িত বুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন মনে হল শহরের কংক্রিটের জঙ্গল থেকে সহস্র যোজন দূরে একটি স্বর্গরাজ্যের বুকে আমরা সুন্দরের সাধনায় রত। আজও চোখ বুজলে সেইসব মুহূর্ত জল ছবির মত জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাহাড়ের নিরালায় দুদিন কাটিয়ে আসতে চাইলে রুকস্যাক গুছিয়ে অবশ্যই পৌঁছে যান লেপচাজগৎ।‘টুং-সোনাদা-ঘুম পেড়িয়ে… আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে… যখন-তখন পৌঁছে যাওয়া যায়…’ (সমাপ্ত)
রুকস্যাক
ভ্রমণ : বাগুরানের বেলাভূমিতে।
দেবস্মিতা ঘোষ : বাতাসে শীতের আমেজ, সোনালী রোদের অকৃত্রিম স্নেহে আগলে নেওয়া স্বভাব, সুনীল আকাশ সবে মিলে প্রকৃতি যেন কোল পেতে বসে দুবাহু বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আর আপনিও বুঝি নাগরিক ঘোড়দৌড়ে বিধ্বস্ত ????
বেশি নয়, ব্যস্ততার চোখরাঙানি থেকে এক কি দুই দিনের ছুটি বন্দোবস্ত করতে পারলেই মিলবে মুক্তির আস্বাদ। দিগন্তজোড়া নীলের মেলবন্ধন, চোখের পাতায় নেমে আসা বালির চড়, গর্জনরত সমুদ্রের ঢেউ এর মাঝে একান্তে অবসার কাটাতে পৌঁছে যান পূর্ব মেদিনীপুরের বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্র তটে।
কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে বা হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন এ কাঁথি পৌঁছে যান। কাঁথি থেকে টোটোতে ২৫০-৩০০ টাকার বিনিময়ে প্রায়ে ২৪ কিমি পথ অতিক্রম করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান বগুড়ান জলপাই এর সমুদ্রতীরে। সমুদ্র এখানে শান্ত।
আর একটি অভিনব বিষয় হল জোয়ারের সময় সমুদ্র তীরের অনেক কাছে চলে আসে আবার ভাটার সময় অনেক দূরে চলে যায়। সারা তত জুড়ে দেখতে পাওয়া যায় লাল কাঁকড়ার অবাধে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলা। সমুদ্রে সূর্যোদয় সাক্ষী থাকা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তাই হাতে ছুটি একদিন বেশি থাকলে একদিন থেকে যাওয়ায় ভালো।
দিঘা, মান্ডারমনি বা জুনপুটের মতো পর্যটন এর ঘেরাটোপ বগুরান কে গ্রাস করেনি এখনো। তাই অফবিট এ নিরিবিলি ছুটি কাটানোর সেরা ঠিকানা হল বগুরান। জুনুপুট সমুদ্রতীর, দরিয়াপুর, কপালকুণ্ডলা মন্দির কাছাকাছির মধ্যেই ঘুরে দেখে নেয়া যায়। এখান থেকে আপনি আশে পাশের সমুদ্রসৈকত গুলিও ঘুরে আসতে পারেন যেমন বাঁকিপুট, দিঘা, মান্ডারমনি, তাজপুর।
তবে এখানে রাত্রিবাসের একমাত্র ঠিকানা হলো হোটেল সাগর নিরালা। কারণ খুব বেশিদিন হয়নি বগুরান বাংলার ভ্রমণ মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। শহুরে জীবন যেসমস্ত সুবিধায় অভ্যস্ত সেই সব রকম সুবিধা এবং তিনবেলার আহার নিয়ে রাত্রিবাসের খরচ মোটামুটি কমবেশি ১০০০ টাকা।
এই শীতে তবে উইকেন্ডে প্ল্যান করেই ফেলুন বগুরান জলপাই সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে বালিতে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে কেটে, কিংবা লাল কাঁকড়ার দল কে গর্ত অবধি ধাওয়া করে, কিংবা আবার ভোরের আধো আলোয় প্রিয়জনের সাথে ঝিনুক কুড়িয়ে দারুন কাটবে ছুটির দিনগুলো।