Uncategorized
সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠার আগে…
সৌমেন্দু বাগ : ৬৫ বছর আগে , এক প্রতিভাবান ,চঞ্চল প্রকৃতির মানুষ , তার বিজ্ঞাপন অফিসের কাজ ছেড়ে সিদ্ধান্ত নিলেন সিনেমা বানাবেন এবং তৈরি হলো ইতিহাস। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধন্য গড়পারের বাড়িতে জন্মানো ছেলেটা ছোট থেকে দেখে আসছে বাড়ির প্রেসে ছাপছে ‘ সন্দেশ ‘ , সেখানে রং বেরঙের ছবি, কত গল্প, কবিতা। ফলস্বরূপ বাড়ির অন্যান্য ছেলের মত এই ছেলেও যে রায় পরিবারের নাম উজ্জ্বল করবে সেতো বলাই বাহুল্য। কিন্তু সে যে সমস্ত উচ্চতা কে অতিক্রম করে নিজেই এভারেস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন , তা কি কেও বলতে পেরেছিল? প্রেসিডেন্সি তে সাইন – কোসাইন এর আক্রমন কোনরকমে সামলে পৌঁছলেন রবি ঠাকুরের আশ্রমে, নিজের প্রাণের কাছে, বনবিহারী বাবুর প্রতি এতোই শ্রদ্ধা ছিল যে পরে তাঁকে নিয়ে ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন ।
সেখানেও মন টিকলো না, একদিন সকাল বেলা উঠে কি মনে হলো কলকাতা চলে এলেন , তখন ওদিকে জাপানি সৈন্য কলকাতায় বোমা ফেলেছে। সত্যজিৎ চাকরি নিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি. জে. কাইমার ( যা পরে ক্লারিয়ন, ক্লারিয়ন – ম্যাক কান , আবার ক্লারিয়ন এবং শেষে বেটস নামে পরিচিত হয়েছিলো) এর ক্রিয়েটিভ বিভাগে। আবার সেইসঙ্গে কাজ করছেন সিগ নেট প্রেসএর অলংকারিক হিসেবে। এই সিগ নেট প্রেস তখন বাংলা সাহিত্যে প্রায় বৈপ্লবিক অবদান রাখার চেষ্টা করছে। তাদের সাথে সত্যজিৎ যুক্ত হওয়ায় যেন ক্ষ্যাপা পরশ পাথর খুঁজে ফেললো।
সেই সময় প্রায় সিগ নেট থেকে বেরোত বিখ্যাত সব বই আর মলাটে থাকতো সত্যজিতের অসাধারণ হাতের কাজ, পাঠক মলাট দেখেই বই কিনতে শুরু করলো। তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজ কাহিনীর অলংকরণ করলেন রাজস্থানি স্টাইলে যা সেইসময় বাংলা শিল্পে অভাবনীয় ছিল। জিম করবেটের বিখ্যাত বই ‘ দি ম্যান ইটার অফ্ কুময়ুন’ যখন বাংলায় অনুবাদিত হলো, সত্যজিৎ আঁকলেন তার মলাট। কী আঁকলেন? পুরো দুদিকের মলাটকে বাঘ্ছালের মত মুরলেন আর শরীরে বুলেট ঢুকলে সামনে থেকে যেমন দেখতে লাগে, তেমন টা করলেন সামনের মলাট, আর পিছনটা ওই বুলেট বেরিয়ে গেলে যেমন দেখতে লাগে পিছন থেকে, ঠিক সেরকম। গোটা ভূ ভারতে কেও এরকম পর্যায়ের সৃষ্টিশীলতা দেখতে পারেনি।
ওদিকে সুদূর মার্কিন মুলুকে মিল্টন গ্লেসার যা করছিলেন , ভারতীয় চিত্রশিল্পে ঠিক তাই করছিলেন সত্যজিৎ রায়। অজান্তেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতের প্রথম ‘ গ্রাফিক ডিজাইনার’ । এমনকি তিনি নিজের দুটো টাইপ ফেস ও তৈরি করেছিলেন – রে রোমান, রে বিজারে।কিন্তু বিধাতা তাঁকে তো শুধু এখানে আটকে রাখবে না। আঁকার পাশাপাশি তাঁর যে বিষয়ে প্রেম ছিল , তা ছিল সিনেমা এবং পশ্চিমী ক্লাসিক্যাল মিউজিক। স্কুলজীবন থেকেই হলিউড পত্রিকা ‘ ফটোগোয়ার ‘,’ ফোটো প্লে ‘ গোগ্রাসে গিলে খেতেন। সেই সঙ্গে পোকার মতো খেতেন হলিউড ছবিগুলো। ” ডিয়েনা দর্বিন, ফ্রেড আস্টির , জিনজার রজার্স এদের সিনেমা আমি বারবার দেখতাম শুধুমাত্র আর্ভিং বার্লিন এবং জেরোম কর্নের মিউজিক নিজের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য।” ( মায় ইয়ার্স উইথ অপু)
কলেজে পড়া কালীন যখন সমস্ত যুবক যুবতীরা হলিউডের নায়ক নায়িকাদের প্রেমে পড়ছে, তখন তিনি প্রেমে পড়লেন সিনেমার নির্মাণের , তার কবিতার মতো বয়ে যাওয়া ছবির সাথে। তখন তিনি দুটো বই পড়েছিলেন রুশ পরিচালক Vsevolod Pudovkin এর, যিনি তখন তাঁর সমসাময়িক সর্জেই আইনস্টাইন এর সঙ্গে ‘ মন্তাজ’ শৈলীর উন্নতিসাধন করছিলেন – আনুক্রমিক ভাবে ছবি সাজিয়ে একটা শক্তিশালী ভাবনার জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি অনেক খুঁজেপেতে একটা ব্রিটিশ পত্রিকাও জোগাড় করেছিলেন, ‘ সাইট এন্ড সাউন্ড’ তার নাম ছিল।পশ্চিমী ক্লাসিক্যাল মিউজিকের প্রতি ও তাঁর ভালোবাসা অদম্য ছিল। কলেজ জীবনে সমস্ত হাত খরচ, খরচ করে দিতেন বিখ্যাত সব রেকর্ডস কিনে।এমনকি তাঁর আড়াই বছরের শান্তিনিকেতন পর্যায়ে যখন তিনি সিনেমা দেখার তেমন সুযোগ পাচ্ছেন না, তিনি এক জার্মান অধ্যাপক আলেক্স আরনসন এর সাথে বন্ধুত্ব জমান এবং প্রায় প্রত্যেক সন্ধে তিনি ওই অধ্যাপকের ঘরে কাটাতেন গান শুনে এবং সেই সম্বন্ধে আড্ডা মেরে।
২য় বিশ্বযুদ্ধর দামামা বেজে গ্যাছে। গোটা কলকাতা আমেরিকান সৈন্যে ছয়লাপ। ফলে তাদের জন্য আমেরিকান ছবি গুলোও এবার কলকাতায় আস্তে শুরু করলো, সত্যজিতের কাছে এর থেকে বড়ো সুযোগ আর হইতো আসেনি জীবনে তাঁর ফিল্মের প্রতি ভালোবাসা কে আরো উদ্দীপিত করার জন্য। এবং প্রায় দুবছরের মধ্যে তিনি ফিল্ম সম্বন্ধে এতো দক্ষ হয়ে উঠলেন, যে যেকোনো সিনেমার পরিচালক এর নাম আন্দাজ করা তো বাচ্চাদের খেলা, তিনি সিনেমার সম্পাদনার কাজ দেখে বলে দিতে পারতেন এটা কোন স্টুডিও এর কাজ – এমজিএম, ওয়ার্নের ব্রাদার্স, ফক্স নাকি অন্য কেও। এই প্রতিভা স্বাভাবিকভাবেই অসাধারণ ছিল, কারণ মনে হয় সম্পাদকরা ও তাঁদের কাজের নির্দিষ্ট ধরন টাকে নিজের বেখেয়ালেই অনুসরণ করে ফেলেন।আর স্থির থাকতে পারছেন না তিনি, সাতচল্লিশে বন্ধুদের নিয়ে গড়ে ফেললেন কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি, ভারতে সম্ভবত প্রথম কোনো ক্লাব যেখানে বিশ্বের স্রেষ্ঠ সব সিনেমা দেখা এবং আলোচনা করা হবে।
এরই মাঝে উনপঞ্চাসে কলকাতা এলেন ফরাসি চিত্র পরিচালক জিয়ন রেনোয়া, তার ছবি ‘ দি রিভার ‘ এর জন্য রেকি করতে, সত্যজিৎ এই সুযোগ ছাড়েননি। জুড়ে লেগেন তার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য স্থানে যখন গেলেন, একজন গাইড, দোভাষী এবং এক আগ্রহী ছাত্র হয়ে। এই রেনোয়ার প্রভাব তার জীবনে এতটাই প্রতীয়মান ছিল যে তিনি নিজে স্বীকার করেছেন ‘চারুলতা ‘ ই মাধবী দেবীর দোলনায় দোল খাওয়ার সিন টা কিংবা ‘পথের পাঁচালী ‘ তে বৃষ্টির মন্তাজ দৃশ্য , এরকম অনেক দৃশ্যই তৈরি করেছেন তার এই ‘ প্রথম শিক্ষক ‘ কে শ্রদ্ধা জানিয়ে।অন্যদিকে তিনি যদিও তার পেশায় অসাধারণ নজির সৃষ্টি করছেন একের পর এক, কিন্তু মন পড়ে আছে সেই ক্যামেরার পিছনে। ( বলতে গেলে রায়বাবুই ছিলেন সেই সব মানুষের পথিকৃত্ যারা নিজের পেশা ছেড়ে সিনেমা জগতে পা রাখেন ; পরে শ্যাম বেনেগাল কিংবা দিবাকর ব্যানার্জী)
প্রেসে কাজ করার দরুন তার হাতে এসে পড়তো বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সব সৃষ্টি। প্রখর দ্রুততার সাথে সেগুলো পড়ে ফেলতেন তিনি। এইভাবে প্রায় গোটা বাংলা সাহিত্য কে ঠটস্থ করে ফেলেছিলেন। তখনই তিনি প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন সিনেমা বানাতে গেলে এই সাহিত্য জগতের থেকে বড়ো রিসোর্স আর কোথাও পাবেন না। প্রথমে ভেবে রেখেছিলেন রবি ঠাকুরের ‘ ঘরে বাইরে ‘ দিয়েই রুপালি পর্দায় অভিষেক করবেন। চিত্রনাট্য ও লিখে ফেলেছিলেন, (কিন্তু কেনো করেননি তার কোনো ব্যাখ্যা পাইনি। যদিও ৪ দশক পরে তিনি সেই ছবি বানিয়েছিলেন।)তারপর তিনি হাতে পান বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ পথের পাঁচালী ‘। নতুন লেখক, নতুন ধাঁচে লেখা। এই লেখা পরে চমকে গেলেন সত্যজিৎ, আবেগ এভাবেও দেখানো সম্ভব। তখন ই মনস্থির করে ফেলেন সিনেমা বানালে ‘ পথের পাঁচালী ‘ ই ।কিন্তু এই উপন্যাস কিভাবে সিনেমা হতে পারে? কোনো প্রেম নেই, নাচ – গানের সুযোগ নেই, সাসপেন্স এলিমেন্ট নেই, এমনকি হ্যাপি এন্ডিং ও নেই ! বিপ্লবীকে আর কি মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে আটকানো সম্ভব?১৯৫০, রায়বাবুকে পাঠানো হলো লন্ডন প্রেসের কাজে পাঁচ মাসের জন্য। কিন্তু এই পাঁচ মাস সত্যজিৎ কে তার নিয়তির দিকে এগিয়ে দিল। দেখলেন রেনোয়ার ‘ লা রেগলে দে জিউ’ , আরো সব বিখ্যাত কত কিছু। তারপর একদিন দেখলেন ‘ বাইসাইকেল থিভস ‘( বা থিফ) যা তার জীবনকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেললো। হল ছেড়ে বেরিয়ে ঠিক করে ফেললেন আর বিলম্ব নয়। তিনি নিজেই বলেছেন, এই ছবি তাঁকে এতটাই উত্তেজিত করেছিলো যে তিনি এই সিনেমা জগতে পা ফেলার ব্যাপারে আর দুবার ভাবেননি। ডে সিকা যেভাবে ‘ বাইসাইকেল থিভস’ বানিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই পথের পাঁচালী বানাবেন, অপেশাদার অভিনেতা, রিয়াল লোকেশন, সাধারণ বাজেট নিয়ে। মনের অবচেতনে কোথাও এই ভাবনাটাই ভেবেছিলেন তিনি, শুধুমাত্র প্রেরণা খুঁজছিলেন, তারপর… তারপর ৩ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে , প্রায় কর্পদক শূন্য করে তৈরি করলেন ‘ পথের পাঁচালী ‘। যাকে প্রসংশা করার আজ আর কোনো আলাদা প্রয়জন নেই। তবুও বলি, রাজ কাপুর এটা দেখে বলেছিলেন, বাঙ্গালী ডিরেক্টর নে ইয়ে তো কামাল কর দিয়া। এবং বম্বে আসার অফার ও দেন।
সেদিন যদি পথের পাঁচালী না বানাতে পারতেন আর ওই আরামপ্রদ বিজ্ঞাপন অফিসের কাজ টা না ছেড়ে নিজের প্যাশনের পেছনে ছুটে না যেতেন, আজ হয়ত ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসটা অন্যরকম হতো । আজ সিনেমাটিক সংস্কৃতিতে আমরা যতটা সমৃদ্ধ হতে পেরেছি, তার জন্য সর্বতোভাবে এই ভদ্রলোকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো আমরা চিরকাল। তিনি ছিলেন রে, কিরণ, আলোর কিরণ যে কিরণ আলোকিত করবে ভারতীয় সিনেমা কে বিশ্বের মঞ্চে। “In my mind, a modulation from a minor to a major key had already taken place. I had served an employer long enough, now I wished to be my own master, working in a different medium with different tools. I was familiar with the camera, possessing a second-hand Leica. And paying homage to a photographer I considered to be the greatest of all—Henri Cartier-Bresson—I wanted my film to look as if it was shot with available light a la Cartier-Bresson… I had absolutely no doubt in my mind that I would become a filmmaker, starting my career with Pather Panchali. If it didn’t work out, I would be back at my desk at Keymer’s, tail between my legs. But if it did work, there would be no stopping me.” (My Years With Apu.)
Courtesy: My years with Apu ‘একেই বলে শুটিংবিষয় চলচ্চিত্র By Satyajit Ray’ ।
Uncategorized
ফেভারিট কেবিন ও উত্তুরে আবেগ : কিছু কথা
অনুপম চৌধুরী : কয়েক’শো দশক ধ’রে অগণিত ইতিহাসের সাক্ষী উত্তর ও মধ্য কোলকাতা আভিজাত্যের পীঠস্থান। বিশালকায় বাড়ি, প্রাসাদোপম সে বাড়ির অন্দরমহল। সে বাড়ির দালান, হেঁসেল, বৈঠকখানা, কলতলা বাচ্চাদের,মায়েদের, কর্ত্তাদের, পরিচারক-পরিচারিকাদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে থাকত। সে বাড়ির বাইরে ‘রোয়াকে’ বসত পাড়ার বিদ্বজনেদের ঠেক, যেখানে চলত খেলা, সিনেমা, রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা, পুস্তক সমালোচনা প্রভৃতি বহুবিধ গুরুতর বিষয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা।
আরও কিছু মানুষ, যাঁদের আড্ডার সাথে চা-বিস্কুট বা নোনতার প্রয়োজন পড়ত, তাঁরা ধারেকাছের ‘কেবিনে’ যেতেন। প্রায় প্রতিটি পাড়াতেই একটি দুটি এ জাতীয় কেবিন ছিল। কিছু কেবিনে মিলত চা-বিস্কুট-কেক-টোষ্ট, আবার কিছু কেবিনে এসব ছাড়াও চপ-কাটলেটের ব্যবস্থা থাকত। এই স্থানগুলিতে বহু খ্যাতনামা বিপ্লবী, সাহিত্যিক, গায়ক, নাট্যকার, সুরকার, চিত্রপরিচালক, বিজ্ঞানীদের আনাগোনা ছিল।
এই জায়গাগুলিতেই চায়ের কাপে চুমুকের সাথে সাথে বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে, বহু কালজয়ী গান সুরারোপিত হয়েছে, বহু নাটকের সংলাপ লেখা ও সম্পাদিত হয়েছে, বহু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দৃঢ় ভিত্তি লাভ করেছে। সহস্রাধিক বিচ্ছেদ ও মিলনের সাক্ষী থেকেছে এই সুপ্রাচীন বিশ-ইঞ্চির গাঁথনি ও কড়ি বর্গার ছাদওয়ালা ঘরগুলি।
এই কেবিনগুলির অধিকাংশই আজ বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলি টিকে আছে সেগুলিও বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। সম্প্রতি, বইপাড়া সংলগ্ন ফেভারিট কেবিন সম্বন্ধেও এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে সেটিও নাকি উঠে যাওয়ারমুখে।
প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এই কেবিনে নয়-দশটি ছোটো মাপের চৌকোণা টেবিল দেওয়াল ঘেঁষে পর পর লাগানো রয়েছে। তার তিন দিকে পাতা রয়েছে তিনটি চেয়ার, কিছু কাঠের আর কিছু প্লাস্টিকের। দোকানটির একদমভিতর দিকটা খানিকটা আলো-আঁধারি, সেখানে জনা পাঁচেক কর্মচারী চা, টোষ্ট বানিয়ে চলেছে।
এখানকার আরও এক বিখ্যাত ও সুস্বাদু খাবার হ’ল পান-কেক, অর্থাৎ পান পাতার আকৃতির কেক। সন্ধ্যা হলেই প্রতিটি টেবিল জুড়ে বসে আড্ডা। কোনোটিতে প্রবীণ-প্রবীণারা, কোনোটিতে প্রেসিডেন্সি বা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বা অধ্যাপক অধ্যাপিকারা আবার কোনোটিতে অন্য একটি দল যারা কলেজষ্ট্রীট গেছিল বই কিনতে। কাপ-ডিশে চা পরিবেশন থেকে শুরু করে ক্যাশ-টেবিলে রাখা মুখসুদ্ধি, সবকিছুতেই রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ।
৬৯বি, সূর্য্য সেন ষ্ট্রীটের এই ঐতিহ্যশালী ফেভারিট কেবিনের সাথে আমার পরিচয় যাঁর হাত ধ’রে, তিনি হলেন বিরল পুস্তক সংগ্রাহক ও বিক্রেতা শ্রী পরিতোষ ভট্টাচার্য্য মহাশয়। তিনিই বলেছিলেন যে- কোলকাতার বুকে এসব আর তেমন একটা নেই, এটা চিনে রাখো। তাঁর কাছেই শোনা, কালান্তরে বহু শরিক হয়ে যাওয়া ও তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকার প্রভাব পড়েছে দোকানগুলির উপর।
শুধুমাত্র ব্যবসাক্ষেত্রেই নয়, উত্তর ও মধ্য কোলকাতার অধিকাংশ সেকালের বাড়িই শরিকদের মধ্যে বাড়বাড়ন্ত মনোমালিন্যের কারণে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভগ্নপ্রায়। সে বৈঠকখানার পাখায় ঝুল জমেছে, হেঁসেলে আর ভাত চাপে না, খাবার আসে রেস্তোরাঁ থেকে। আর, বাঙালি পারিবারিক ঝুট-ঝামেলা মেটাবার পশ্চিমী পন্থা অবলম্বন করে বাড়িগুলি তুলে দেয় প্রোমোটারদের হাতে। সেখানে তৈরী হয় দশ-বারো তলার অ্যাপার্টমেণ্ট। সমস্ত অংশীদার নিজ নিজ পাওনা বুঝে নিয়ে ক্ষান্ত হয়। বাসা পরিণত হয় খাঁচায়, কুলায় পরিণত হয় পিঞ্জরে।
কিছু বাড়ি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। সেকালের বিদ্বজনেদের যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁরা এখনও কোনো একসময় এসে সেই রোয়াকে বসেন।আড্ডাও চলে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আড্ডার বিষয়বস্তুও বিস্তর পরিবর্তিত হয়েছে। এখন তাঁরা নবীনচন্দ্র সেন’কে অনুসরণ করে বলেন – “কালি যেই স্থানে ছিল বৈজয়ন্ত ধাম, আজি দেখি সেই স্থানে বিজন কানন”।