কলমের আঁচড়ে
চড়া মেকআপ পিষেছে শৈশব…!
দেবাশ্রিতা রায় : Primer, concealer foundation স্তরের উপর স্তর চাপিয়ে শেষে highlighter এ মুখের কালো দাগ কোথায় জানি মিলিয়ে গেল, ঠিক মাইকা খনির সরু গলিটার মতো, যেখানে দিনের পর দিন নিকষ কালো অন্ধকারে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে এক একটি প্রাণ। ঝা-চকচকে রঙিন eyeshadow palette টার উল্টোদিকটা বড্ড বেরঙীন, যেখানে makeup brush এর বদলে হাতে দেখা যায় ice picks, হাতুড়ি আর ঝুড়ি।
ভারতবর্ষের মধ্যেই প্রধানত বিহার, ঝাড়খন্ড থেকে মাইকা মেকআপ শিল্পে যায়। কুড়িহাজারেরও বেশি শিশু এই মাইকা খনিতে কাজ করে, যাদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ৪ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। খনির সংকীর্ণগলিরমধ্যে বাচ্চাগুলোর যাতায়াতের সুবিধার জন্য শিশুশ্রমিক নিযুক্ত করা হয় বেআইনিভাবে। পেন্সিল ধরার বদলে ছোট ছোট আঙুলগুলো মাইকার ছোট টুকরো আলাদা করার কাজে লাগে। ভারতের এই দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় সুদূর আফ্রিকা প্রদেশের মাদাগাস্কারে যা বিশ্বের বৃহত্তম মাইকা রপ্তানিকেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম। মাদাগাস্কারে প্রতি কিলো মাইকা পিছু ৩৪পয়সা দেওয়া হয় শ্রমিকদের যা ভারতের শ্রমিকদের মজুরির অর্ধেকেরও কম। খনি থেকে মাইকা সংগ্রহের পর দালাল মারফত তা রপ্তানিকারকদের হাতে যায় এবং সেখান থেকে কারিগরের কাছে পৌঁছায়।
শিশুশ্রমিকরা স্কুলের রাস্তার বদলে খনির রাস্তা ধরে জীবনধারণের উদ্দেশ্যে।তবে জীবনের বদলে বেশিরভাগ শ্রমিকের কপালে জোটে পেশির ব্যাথা, পিঠে ব্যাথা, কালশিটে, শ্বাসকষ্টের মতো রোগ, আবার কখনো কখনো ধ্বসে চাপা পড়ে মৃত্যু। দেশের বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় এবং জীবিকা নির্বাহের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় এই পথ বেছে নিতে হয় বলে দাবি করেন খনি অঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামবাসীরা। ঝাড়খণ্ডের আমঝাড় গ্রামের পনেরো বছরের রিতিকা মুর্মুর চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। খনির ধ্বসে চাপা পড়ে চোখের সামনে তার বন্ধু ও বৌদি মারা যায়। রিতিকা মুর্মু বলে,“আমি কোনদিন আর যাবো না খনিতে কাজ করতে, বাকিদেরও বারণ করবো”। কিন্তু তার দাদা মতিলাল মুর্মু ঘটনাটি অস্বীকার করে। জীবিকানির্বাহের একমাত্র রাস্তা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে খাবে কি! তাই প্রাণ হাতে নিয়ে তাদের আবার নেমে পড়তে হয় কাজে। শিশুদের জীবনকেনা হয় টাকার বিনিময়ে। টাকা দিয়ে বাড়ির লোকের মুখ বন্ধ করা হয়। কতজন খনির অন্ধকারে তলিয়ে গেল হিসেব থাকে না তার।
তবে বিভিন্ন কোম্পানি জোটবদ্ধ হয়ে এই সমস্যা সমাধানের জন্য RMI (Responsible Mica Initiative) গঠন করেছে। যেমন- Lush সিন্থেটিক মাইকার ব্যবহার শুরু করেছে, loreal একটা নির্ভেজাল চেন তৈরিকরার চেষ্টা করছে যেখানে কোনো শিশুশ্রমিক থাকবে না। RMI খনি অঞ্চলের শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে এবং শিশু এবং মহিলাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার দিকে নজর দিয়েছে। এছাড়াও গ্রামবাসীরা যাতেঅন্যকোনো জীবিকা বেছে নিতে পারে সেই চেষ্টাও করছে।
কলমের আঁচড়ে
পৃথিবীর বুকে মেনে চলা কিছু বিস্ময়কর এবং ভয়ঙ্কর সত্কার-রীতি!
বিশ্বজিৎ দাস : কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলে গেছেন “জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে?” অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করলে আমাদের মৃত্যু অনিবার্য। মানুষের মৃত্যুর পর সৎকার করা হয়। সভ্যতার প্রথম দিক থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। এই সৎকারের সময় টা খুবই কঠিন, বিশেষত নিকটজনের কাছে। সে সব আঁকড়ে থাকে, কারণ একবার ছেড়ে দিলে আর পাওয়া যাবে না। এই ভাবাবেগ থেকেই স্মৃতি রক্ষার ভাবনা শুরু। মৃতের ব্যবহৃত জিনিস রেখে দেওয়া, যেমন চুল কিছুটা কেটে যত্ন করে রেখে দেওয়া ছিল পুরনো প্রথা। অনেকে দাঁত সংরক্ষন করত। বুদ্ধের দাঁত কলকাতার জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে আজও।
কিন্তু পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির মধ্যেই মৃত্যুর পর কিছু বিশেষ নিয়ম পালন করার রীতি আছে। কিছু নিয়ম বিজ্ঞানসম্মত আবার কিছু একেবারে অদ্ভুত। মৃতদেহ সত্কারের জন্য কেউ যেখানে মৃতদেহটি পুড়িয়ে ফেলেন, আবার কেউ বা মাটিতে কবর দেন। আবার কেউ বা সযত্নে সেটিকে কফিনজাত করেন। কিন্তু এসবের বাইরেও এমন অনেক রীতিনীতি আছে যেগুলি আমার আপনার স্বাভাবিক ভাবনা চিন্তার বাইরে।
সাধারণ মানুষের কাছে মৃত ব্যক্তিকে মাটিতে কবর দিয়ে রাখা বা আগ্নিদাহ করা পরিবেশগত কারণে মোটামুটি স্বাভাবিক মনে হলেও কিছু কিছু সংস্কৃতিতে মৃত ব্যক্তি সমাহিত করার পদ্ধতি অবাক করার মতো।
পৃথিবী জুড়ে চলা এই আশ্চর্য ও কিছুটা ভয়ঙ্কর মৃত্যু অনুষ্ঠান গুলি হল :
১. মমিফিকেশন :
এই ঘটনা আমার আপনার কিছুটা জানা। প্রাচীন মিশরের ফারাওদের মরদেহ মমি করে সমাহিত করা হতো। এই পদ্ধতিতে প্রথমে দেহের অভ্যন্তরীণ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করা হয়। এরপরে দেহের সব আর্দ্রতা অপসারিত করা হয়। শেষে লম্বা আকৃতির লিনেন কাপড় দিয়ে দেহ মুড়ে ফেলা হয়।
তবে আধুনিক মমিফিকেশন পদ্ধতি আলাদা।বর্তমানে মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য কিছু রাসায়নিক তরল ভর্তি পাত্রে দেহ ডুবিয়ে রাখা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটি মৃতদেহ সৎকারের কোনো রীতি নয়; এটি মৃতদেহ সংরক্ষণ পদ্ধতি।
২. মৃতের পুনর্জাগরণ :
এই অদ্ভুত প্রথাটি পালন করা হয় মাদাগাস্কায়। প্রতি পাঁচ থেকে সাত বছর পর পর। তার নিকটাত্মীয়রা কবর খুঁড়ে মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষ বের করে আনে। এরপর মৃত ব্যক্তিকে নতুন পোশাক পরানো হয় এবং পারিবারিক ভোজে তাকে বসিয়ে রাখা হয়।এদিন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে গানের তালে তালে নাচতেও দেখা যায়। পারিবারিক পুনর্মিলন হিসেবে প্রথাটিকে দেখা হয়।
৩. এন্ডোক্যানিবালিজম (Endocannibalism) :
এই বিশেষ মৃত্যু অনুষ্ঠানটি দেখতে পাওয়া যায় আমাজন রেইন ফরেস্টের ইয়ানোমমি উপজাতি, পাপুয়া নিউ গিনির মেলানসিয়ানস উপজাতি এবং ব্রাজিলের ওয়ারীরা উপজাতির মধ্যে।এখানে একটি মৃতদেহকে বা দেহাংশকে ভক্ষণ করা হয়। তাদের বিশ্বাস এই প্রথার মধ্যে দিয়ে মৃত ব্যাক্তির আত্মা স্বর্গে যাবে।
এই জাতির মানুষেরা বিশ্বাস করেন, মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। উপরন্তু তারা ভাবেন যে, তাদের প্রতিদ্বন্দী গোষ্ঠী কোনো অশুভ আত্মাকে প্রেরণ করেছে। সেই কারণে এই ঘটনা রোধ করার জন্য তারা এই অনুষ্ঠানটি করে থাকেন। যাতে মৃত ব্যাক্তির আত্মা জীবিত থাকে এবং তার পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারে।
এই অনুষ্ঠানটি করার জন্য প্রথমে তারা মৃতদেহটিকে পাতা দিয়ে মুড়ে বাড়ি (যেখানে তিনি মারা গেছেন) থেকে অল্প দূরে জঙ্গলে রেখে আসেন। এর পর মোটামুটি ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মাথায় সেই পঁচাগলে যাওয়া মৃতদেহ থেকে হাড় সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। এরপর কলা দিয়ে বানানো একধরণের সুপের মধ্যে মৃতদেহের ছাই মিশিয়ে গোষ্ঠীর সকলে সেটি পান করে। তবে এই নিয়ম শুধুমাত্র গোষ্ঠীর শিশু ও মহিলারা পালন করেন।
৪. তিব্বত বৌদ্ধ মহিমা কবর/ তিব্বতের আকাশ সৎকার (Tibetan Buddhist Celestial Burials or Sky burial) :
এই সৎকার অনুষ্ঠানটি তিব্বতি ঐতিহ্যের প্রতীক। এই অনুষ্ঠানে মৃতদেহকে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে পাহাড়ের মাথায় রেখে আসা হয় এবং পাখিদের (বিশেষত শিকারী পাখিদের) ওই দেহাংশ ভক্ষণ করতে দেওয়া হয়। অনেক সময় অক্ষত মৃতদেহও রেখে দেওয়া হয় এই পাখিদের খাদ্য হওয়ার জন্য।
বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে মৃতদেহকে খালি জাহাজ মনে করা হয় যা সংরক্ষনের কোনো দরকার নেই।মূলত, তিব্বতের কঠিন জলবায়ু ও পাথরে ভরা জমিতে কবর দেওয়া এক পক্ষে অসম্ভব।৫. সাসপেন্ড কবরস্থান (Suspended Burials) : এই সৎকার অনুষ্ঠানটি প্রাচীন চীন বংশের মধ্যে দেখা যায়। এখানে তারা মৃতদেহকে কফিনে পুড়ে উঁচু পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত শিলার উপর ঝুলিয়ে রেখে দেয়। সাধারণের বিশ্বাস, মৃতদেহকে আকাশের কাছাকাছি রাখা উচিত যাতে তারা বন্য প্রাণীদের নাগালের বাইরে এবং ভগবানের নাগালের মধ্যে বা কাছাকাছি থাকতে পারে।
৫. সতী :
উপযুক্ত কারণেই হিন্দু ধর্মে সতীদাহ প্রথার প্রচলন বর্তমানে নিষিদ্ধ। তবুও একটা সময়ে এই নিষ্ঠুর ও অমানবিক সৎকার হিন্দু ধর্মের এক সনাতনী ঐতিহ্য হিসাবেই মানা হত। এই রীতি অনুযায়ী, মৃত ব্যাক্তির স্ত্রী কে বধূবেশে সাজিয়ে একই চিতায় মৃত্যু বরণ করতে হত। সেই সময় দাবি করা হত, সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে মৃত স্ত্রী সতিরূপে স্বর্গলাভ করবে।
৬. ভাইকিং ফিউনারেল (The Viking Funeral) :
এটি একটি অন্যতম নৃশংস সৎকার অনুষ্ঠান। এই রীতি অনুযায়ী মৃতদেহকে একটি অস্থায়ী কবরে দশ দিনের জন্য রাখা হত। পাশাপাশি চলত মৃতের জন্য নতুন জামাকাপড় তৈরির কাজ। অন্যদিকে একজন ক্রীতদাসীকে বেছে নেওয়া হত, যে ওই মৃত মানুষটির পরবর্তী জীবনের সঙ্গিনী হবে। এরপর সেই মেয়েটি ওই গ্রামের সকলের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতো। তাদের মতে এই বর্বরতায় নাকি ছিল মৃতব্যাক্তির প্রতি প্রেম নিবেদন। তারপর ওই দাসীর গলায় ফাঁস দিয়ে এবং সবশেষে ছুরি মেরে হত্যা করা হতো।
এরপর একটি কাঠের জাহাজে মৃত ব্যাক্তির সাথে তাকেও রেখে দিয়ে অগ্নি সংযোগ করা হত।
৭. আঙুলের আবৃততা (Ritual Finger Amputation) :
এই মৃতদেহ সৎকারের নিয়মটি পাপুয়া নিউ গিনির দানি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত।
এই নিয়ম অনুযায়ী বাড়ির কোনো প্রিয় ব্যক্তি মারা গেলে তার সঙ্গে সম্বন্ধিত মহিলা ও শিশুরা তাদের আঙুলের কিছু অংশ কেটে ফেলত। এরপর কাদা ও ছাই মুখে মেখে মৃতব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশ করত।
৮. টোটেম পোলস (Mortuary Totem Poles) :
স্থানীয় সভ্যতার বিভিন্ন গল্প তুলে ধরার জন্য টোটেম পোল তৈরি করা হয়। হায়দা উপজাতির মধ্যে এই রীতি দেখতে পাওয়া যায়। এই রীতি অনুযায়ী মৃতব্যাক্তির শরীরকে পেটানো হবে যতক্ষন না এটি একটি ছোট বাক্সে এঁটে যায়।এরপর এই বাক্সটি একটি টোটেম পোল এর উপর রেখে মৃত ব্যাক্তির বাড়ির সামনে রেখে আসা হয়।
৯. বারিড ইন ফ্যান্টাসি কফিন (Buried in a fantasy Coffin) :
এই রীতি অনুযায়ী মৃতদেহকে এমন একটি কফিনে রাখা হয় যেটি তার জীবনকে অথবা পেশাকে উপস্থাপনা করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বিমান চালক কে বিমানরূপী কফিনে, কোনো জেলেকে মাছরূপী কফিনে আবার কোনো ধনী ব্যাবসায়ীকে একটি দামি গাড়ীরূপী কফিনে রাখা হয়।
১০. অন্ধ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া (Blindfolded funeral) :
এই মৃতদেহ সৎকারের রীতি অনুযায়ী মৃতদেহের চোখ বেঁধে তাকে বাড়ির মুখ্য দরজার সামনে রেখে দেওয়া হয়। এটি দেখা যায় উত্তর পশ্চিম ফিলিপিনেসে।
এছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে আরও নানান ধরনের অদ্ভুত এবং ভয়ংকর সৎকার অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া যায়।