রিভিউ
দিল বড্ড বেচারা। মুভি রিভিউ : দিল বেচারা
সৌমেন্দু বাগ : কেও কথা রাখেনি। প্রায় এক বছর আগে এক বর্ষার রাতে ঘোষিত হয়েছিল পৃথিবীবিখ্যাত উপন্যাস ‘দি ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্স’ এর অনুকরণে ছবি হতে চলেছে। মুখ্য ভূমিকায় সুশান্ত সিং রাজপুত আর সঞ্জনা সাংঘবি। সোশ্যাল মিডিয়া ট্রোলে ভরে গিয়েছিল। আজ সেই দর্শক কথা রাখেনি, দশে দশ রেটিং দিয়েছে। আর সেই রাতেই গাস-হেজেলের প্রেমে মুগ্ধ কিশোর কিশোরী কথা দিয়েছিল তারা একসাথে দেখতে যাবে সেই ছবি। তারাও কথা রাখেনি। কথা রাখেনি মানি। কথা রাখেনি মানি কে ফুটিয়ে তোলা সুশান্ত সিং রাজপুত।
এত কথা না রাখার মাঝে যাকে সেলিব্রেট করা শিল্পীদের কাজ, সেই ছবি কেমন হয়েছে? বড়ই কঠিন এ উত্তর। আবার এ প্রশ্ন উত্তরের দাবি করে না! সে শুধুমাত্র জীবন মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্মৃতিচিহ্ন যাকে ছুঁলে যেন ছুঁতে পারি আমরা সেই শিল্পীকে। ‘দিল বেচারা’ যেন সুশান্তেরই জীবন-কাহিনী। মানি যেন অবচেতনে সুশান্তের প্রতিভূ। জীবন নামক প্রতিকুল উপত্যকায় কিজি বাসুর কাছে সে যেন আসে এক প্রতীক্ষিত কিন্তু অপ্রত্যাশিত বসন্তের মতো। মৃত্যুকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাওয়া মনেদের সে বোঝায় কিভাবে মৃত্যকে দু’চোয়ালের মাঝে আটকে রেখে তাকে বোকা বানানো যায়। এই খেলায় শেষ অবধি জিতে যাবে শেষ অবধি সেই মৃত্যুই, কিন্তু শেষ বল অবধি লাগাম টেনে ধরে রাখার নামই তো জীবন।
কিন্তু এই সমস্ত কথা , সব শিক্ষা আমাদের ইতিমধ্যে একটি অসাধারণ উপন্যাস আর সেই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবি দিয়ে ফেলেছে। তাহলে ‘দিল বেচারা’ এর উপযোগিতা কোথায়? ‘রিমেক’ মানে কি তাই? শুধু এক ভাষার শিল্প অন্য ভাষার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া? আর কিছু না? উত্তর খুব সহজ। কিন্তু আজ সুশান্তের মৃত্য কে সেলিব্রেট করার জন্য আমরা খুঁজতে চাইছি না সে উত্তর। হয়তো তারা ঠিক। শিল্পীর শেষ কাজকে ভালো খারাপের মাপকাঠিতে না ফেলে ‘স্যুভেনির’ রূপে রেখে দিতে চাইছেন। খুব ভালো কথা। কিন্তু একটাই অনুরোধ আজ যেসব রিভিউয়াররা সমস্ত ইমোশন, কষ্ট সরিয়ে রেখে হনেস্ট মতামত দেবেন তাদের খিল্লি কিংবা খিস্তির পাত্র করে তুলবেন না।
ছবিটি সুশান্তের শ্রেষ্ঠ কাজ নয়। অসাধারণ একটা গল্প নিয়ে কাজ করতে গেলে সিনেমার গল্প নিয়ে যেমন আপনাকে চিন্তা করতে হয় না, তেমনি উল্টোদিকে চিত্রনাট্য নিয়ে আপনাকে দ্বিগুন চিন্তা করতে হয়। ‘দিল বেচারা’ মার খেয়ে গেছে এখানেই। খুব দুর্বল চিত্রনাট্য। দর্শককে চরিত্রদের সাথে সম্পর্কিত হতেই আর গল্প তৈরি করতেই ফার্স্ট হাফ চলে গেল। মূল উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে একটা ‘এডভেঞ্চার’ ছিল(যারা পড়েছেন তারা বুঝবেন) । আর সেটাই গল্পের একটা সম্পদ ছিল। সেটাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে ওই জায়গাটিকে ট্রাভেল ভ্লগ বানিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। আমি তুলনা করছি না, রিমেক এ তুলনা করা উচিতই নয়। কিন্ত তাহলে গল্পের মূল উপজীব্য বিষয় হিসেবে কিছু রাখতে হত। শুধুমাত্র একজন মৃত্যুপথযাত্রী কিশোরীর জীবনের একটা অংশই যদি দেখানো উদ্দেশ্য হত, তাহলে আরও একটু ইমোশনাল, আরো একটু যত্ন করে , সাজিয়ে গুছিয়ে বলা যেত। আরকিজি আর মানির রসায়ন টাও কেবল সুশান্তের অভিনয় দক্ষতার জন্য বেঁচে গেছে ।বড্ড তাড়াহুড়ো করে শেষ হয়ে গেলো সবকিছু। কিন্ত এই সিনেমাটিকে ভালো লাগার কারণ অবশ্যই অভিনয়। স্বস্তিকা মুখার্জি এবিং শাশ্বত চ্যাটার্জির ছোট্ট কিন্তু দুর্দান্ত অভিনয় । সঞ্জনার হাসি আর চোখ দুটো বড্ড সুন্দর, কিন্তু উচ্চারণ আর অভিনয় সেরকম ভালো লাগেনি। আর এদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন একজন। তাঁর ভুবনমোহিনী হাসি থেকে শুরু করে দুষ্টমি ভরা কথা হোক কিংবা হেরে যাওয়ার অসহায়তা – সবকিছুতেই তিনি ‘সুশান্ত’। রয়ে গেল সংগীত। এই একটি জিনিস যা সিনেমাটিকে বয়ে নিয়ে চলেছে, পৌঁছে দিয়েছে সমস্ত হৃদয়ে। এ আর রহমান – বিদায়বেলার সুর তোমার থেকে ভালো আর কে দিতে পারে?
বর্ষার রাত্তিরে কিশোর প্রেমিক তার না রাখা প্রতিশ্রুতির কথা মনে করে। নির্জন পুকরপাড় মনে করে কোনো নামহীন প্রেমিক প্রেমিকার শেষ ঝগড়া। আর আমরাও মনে করব এক ভুবনমোহিনী হাসি আর বড় বড় স্বপ্ন দেখা দুটো চোখ , তারা গুনতে শেখানো দুটো চোখ আমাদের জীবনে আসা এক ম্যাজিসিয়ানের মত থেকে যাবে। সেই ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখিয়েছিলো। মেলার ভিড় হালকা হয়ে এলে সে তাঁবু গুটিয়ে নেয়। তারা ভরা আকাশে নিজের ম্যাজিকে নিজেই ভ্যানিশ হয়ে যায় সমস্ত কোলাহল ,ভয়, নিন্দা থেকে বহুদূরে তাঁর ঠিকানায়।
রিভিউ
মন্ত্রমুগ্ধ সঙ্গীতের এই বান্দিশ। ওয়েব সিরিজ রিভিউ : বান্ডিশ বান্ডিত্স
বিপাশা দাস : পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম জীব হলো গিয়ে মানব। শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকার গুণের ও অংশীদার তারা। সঙ্গীত যার মধ্যে একটি, লক্ষ্য করে দেখবেন নিত্যদিনের প্রত্যেকটি কর্মের মধ্যে আপনি সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন খুঁজে পাবেন। এই আশ্চর্য মেলবন্ধন কে কাজে লাগিয়ে পরিচালক অঙ্কিত তিওয়ারি বান্ডিশ বান্ডিত্স নামক একটি ওয়েব সিরিজ আমাজন প্রাইম এরপর্দায় নিয়ে এলেন।
গুরুর প্রতি শিষ্যের অপার ভক্তি, সঙ্গীতের প্রতি অনবদ্য প্রেম একজন নিষ্ঠাবান শিষ্যের পরিচয়। পুরাকালের কাহিনী তো সবার কাছে জ্ঞাত, গুরুদেব দ্রোণাচার্য একলব্য এর আঙ্গুল গুরুদক্ষিণা হিবেসে চেয়ে গুরুভক্তির নিদর্শন স্বরূপ অক্ষত রাখেন। তেমনি এই ছবিতে রাধে তার টাকুরদা পণ্ডিত রাধেমোহনকে নিজের গুরুভক্তি এবং প্রেমের নিদর্শন কঠোর পরিশ্রমের সাথে দিয়েছে।
এবার যদি সঙ্গীতের ব্যাখ্যা চান তাহলে বলবো যথাযথ তার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ইতিহাসের দিকে নজর দিলে বুঝতে পারবেন সঙ্গীতের মহিমা কতটা ব্যাপ্ত। আকবরের নবরত্ন অলংকৃত তানসেন নিজের সঙ্গীতেরদ্বারা বৃষ্টি নামাতে পারতেন, ক্ষিপ্ত হাতিকে শান্ত করার ক্ষমতা ও তার গানের দ্বারা ফুটে ওঠে। তবে এই ওয়েব সিরিজের শেষে এমনটাই পরিচয় পেয়ে থাকবেন। ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল গানের সঙ্গেপপ মিউজিক এর অসাধারণ যুগলবন্দি সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। সাথে রাজস্থানের সাংস্কৃতিক প্রতিপত্তি,রাজার উপস্থিতি সবকিছুই যেনো ইতিহাসকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট। আমাদের ভারতবর্ষে ফোক গানের কদর এক আলাদা স্তরেই বিদ্যমান, এত সুন্দর ভাবে তার পরিবেশন সাথে বিভিন্ন অসাধারণ কিছু রাগের উপস্থিতি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের প্রেমে পড়ার জন্য যথেষ্ট।
অতুল কুলকর্ণী, নাসিরউদ্দিন সাহ, তৃধা চৌধুরী, শিবা চড্ডা দের মত নামকরা কিছু তারকাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সবার তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয় এর পরিচয় আমরা আগেও পেয়েছি এই ওয়েব সিরিজেওবেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কিন্তু ঋত্বিক ভৌমিক (রাধে) এবং শ্রেয়া চৌধুরী (তামান্না) র অসাধারণ অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। লিড রোল রাধের পুরো ওয়েব সিরিজ টিকে এক আলাদা জায়গায় স্থান দিয়েছে সাথে তার বন্ধু কবীরের কিছু হাস্যকর মুহূর্তও এবং অটুট বন্ধুত্বের সাক্ষী এই সিরিজটি।
ডিরেকশনে র কথা বললে রাজেস্থানের যোধপুর নামক এই শহরটির সৌন্দর্য্য কে নব বধূর সাজের সাথে মিলিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে যা এককথায় অতুলনীয়। কিন্তু কোথাও গিয়ে কিছু খামতি চোখে ধরা পড়েই। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রকাশ থাকলেও অত্যধিক পরিমাণে অকথ্য ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যার ফলে পরিবারের সঙ্গে বসে দেখার কোনো সুযোগই নেই। সিরিজটির শেষের দিকে পপ এবং ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের ছোয়া তো দূর নায়িকার উপস্থিতিই সরিয়ে দেওয়া হয়। লেখার ক্ষেত্রে এসব খামতি এড়িয়ে যাওয়া দায়।
শ্রীরাম গণপথী র চলচ্চিত্রশিল্প সত্যিই খুবই সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এডিটিং এ লিড রোল রাধে র মাস্কড ম্যান এর থিওরী এবং তার উপস্থাপনা কে দুর্বল ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে মনমাতানো গানের যুগলবন্দী টি সত্যিই অবিস্মরণীয়। সেটা যদি নাই দেখলেন তাহলে কি দেখলেন প্রশ্ন করতে হয়। সঙ্গীত জগতের তিন অনবদ্য সৃষ্টিকর্তা কর্তা সংকর মহাদেভান, এহসান এবং লয়ের হাত ধরেই এই সিরিজের যে উত্থান। তাদের গাওয়া প্রত্যেকটি রাগের মধ্যে যে আলাদাই আবেগ, অনুভূতি,বেদনা,বিরহ,প্রেমের স্পর্ধা প্রকাশ পেয়েছে যা সত্যিই না শুনে বোঝা সাধ্যের বাইরে।